এই হোটেলে প্রতিদিন ‘ফ্রি সেহরি’ খাচ্ছে অসংখ্য মানুষ

বাংলাদেশ নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে চরম দুঃসময় পার করছে। অসৎ ও অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের জন্য সাধারণ মানুষের জীবন আজ অতিষ্ঠ। খাদ্য ভেজাল এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে নামিদামি ব্র্যান্ডের পণ্যেও মারাত্মক ঘাপলা ধরা পড়ছে। বলা চলে, এখন সব ব্যবসায়ীদের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে সাধারণ জনগণ।

তবে আশার কথা হলো, এত অসৎ মানুষের ভিড়েও এখনো খাঁটি মানুষ আছে। এত ভেজালের ভিড়ে এখনো শুদ্ধ খাবার আছে। যারা এই দুঃসময়ে ভালো কাজ করছেন, সততার সঙ্গে ব্যবসা করছেন, মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন তাদের সম্মান জানাতে আমাদের অন্তর থেকে শ্রদ্ধা চলে আসে।

আজ বাংলাদেশ টাইমসের পাঠকদের এমনি একজন ভালো মানুষের গল্প শোনাব, যাকে আমরা বলতে পারি ‘অন্ধকারে আলোর প্রদীপ’। আর তিনি হচ্ছেন মো. আবদুর রশিদ।

ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মাতবর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক তিনি। যিনি পুরো রমজান মাস জুড়ে তার হোটেলে আগত অতিথিদের বিনামূল্যে সেহরি খাওয়ান।

আবদুর রশিদের এই কাজে অভিভূত হয়েছেন বরগুনা কোর্টের অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আল সাইদ। তিনি নিজেও সোমবার এই হোটেলে সেহরি খেয়েছেন। কিন্তু তিনি জানতেন না এখানে বিনামূল্যে সেহরি খাওয়ানো হয়। খাওয়া শেষ করে বিল দিতে গিয়ে তিনি হোটেল মালিক আবদুর রশীদের এই মহানুভবতার কথা জানতে পারেন।

মঙ্গলবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অ্যাডভোটেক আবদুল্লাহ আল সাইদ  মাতবর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের নিয়ে বিশাল এক পোস্ট দিয়েছেন। পুরো কাহিনিটা চলুন তার পোস্ট থেকে জেনে নিই।

পোস্টটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

‘রমজানের রোজার মধ্যে রাতের বাসে হাইওয়েতে যাতায়াত করা আমাদের জন্য খুব দুশ্চিন্তার বিষয় না হলেও মোটামুটি চিন্তার বিষয়। কারণ ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের মতো আমাদের ঢাকা-বরিশাল হাইওয়েতে খুব ভালো মানের খাবার হোটেল পাওয়া যায় না। তাই সেহরি খাওয়ার জন্য আমাদের ভরসা করতে হয় রাস্তার পাশে মোটামুটি মানের খাবার হোটেলের ওপর।

এ ভরসার মধ্যে দুইটি চিন্তার বিষয় হল খাবারের মান এবং খাবারের অতিরিক্ত মূল্য। খাবারের মূল্য অনেক সময় হোটেল মালিকরা দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে থাকেন। যাত্রীরা মোটামুটি বাধ্য থাকেন হোটেল মালিকের নির্ধারিত মূল্যে খাবার গ্রহণ করার জন্য। কারণ তাদের হাতে কোনো বিকল্প উপায় থাকে না।

যাত্রীদের এই অসহায়ত্বের সম্পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে হোটেল মালিকরা। তার মধ্যে পুরাতন পচা-বাসি খাবার তো আছেই। আমরা যারা রোজার মধ্যে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসার জন্য রাতের বাসে যাতায়াত করি তারা এই বিষয়গুলোর ওপরে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

আমি কিছুদিন আগে একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য ঢাকায় গমন করি এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে গতকাল (সোমবার) রাত ৯ টায় সাকুরা পরিবহনের একটি বাসে ঢাকা থেকে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা করি।

বাসে উঠে বাসের সুপারভাইজারের সঙ্গে সেহরি খাওয়ার বিষয় নিয়ে কথা বললাম এবং সে আমাকে আশ্বস্ত করল রাত ৩ টার দিকে যে স্থানে হোটেল পাওয়া যাবে ওই স্থানে আমাদেরকে সেহরি খাওয়ানোর জন্য বাস থামানো হবে।

অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আল সাইদের সঙ্গে হোটেল মালিক মো. আব্দুর রশীদ(ডানে)

রাতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডে বাস থামল। যে হোটেলের সামনে বাসটি থামল ওই হোটেলের সামনে আরও ১০ থেকে ১২ টি বাস থামানো ছিল। ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলরত ভালো মানের অধিকাংশ বাসই ওই হোটেলের সামনে থামানো দেখতে পেলাম।

যাত্রীদের সেহরি খাওয়ার জন্য একসঙ্গে অনেকগুলো বাস এই হোটেলটির সামনে থামায় হোটেলটিতে অনেক ভিড় হয়ে গেল। আমি সেহরি খাওয়ার জন্য হোটেলের খাবার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং কিছুক্ষণ পরে একটি চেয়ার খালি হলে আমি ওই চেয়ারটিতে বসি। আমি খাবারের কোনো দাম জিজ্ঞেস না করে খাওয়া শুরু করলাম কিন্তু আমার পাশে একজন যাত্রী হোটেলের বয়কে দাম জিজ্ঞেস করতেই বয় উত্তর দিল দাম লাগবে না কি খাইবেন বলেন।

কথাটা শুনে তখনও বুঝতে পারিনি বিষয়টা কী। আমি খাওয়া শেষ করে বিল দেওয়ার জন্য হোটেলের ম্যানেজারের কাছে যাই। তিনি আমাকে বিনয়ের সঙ্গে বললেন টাকা দেওয়া লাগবে না। আমি বিষয়টি বুঝতে পারলাম না। তাই আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন টাকা দেওয়া লাগবে না। সে আমাকে জানাল, ‘বাবা বছরে ১১ মাস ব্যবসা করি এক মাস আল্লাহর খেদমত করি।’

আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম এবং বিষয়টি ভালো করে বোঝার চেষ্টা করলাম। জানতে পারলাম তিনি হোটেলের ম্যানেজার নন, তিনি হোটেলের মালিক। রমজান মাসে কারও কাছে হোটেলের খাওয়া বাবদ কোনো টাকা গ্রহণ করেন না।

আমার মতো কৌতূহলী হয়ে অনেক যাত্রী তার কাছ থেকে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করল। অনেক যাত্রী অবাক হয়ে হোটেলের মালিকের দিকে তাকিয়ে রইল। তার হোটেলের বয়রাও অনেক আন্তরিক। যে কোনো একজন খাবারের জন্য চেয়ারে বসলেই সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করে কি খাবেন মাছ না মাংস। মাছ হলে কোন মাছ মাংস আর মাংস হলে কিসের মাংস?

যেখানে বাংলাদেশ রমজান মাসে ব্যবসায়ীরা পণ্য মজুদদারি করে মূল্য বৃদ্ধি করে। ভেজাল পচা-বাসি এবং অতিরিক্ত মূল্যে পণ্য বিক্রির দায়ে ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করে নামিদামি খাবার হোটেলগুলোতে জরিমানা করেন।

সেখানে গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডের কাছে এই হোটেল মালিক স্রোতের বিপরীতে ব্যবসা করা একজন মানুষ। যে মানুষ রমজান মাসে রোজাদারদের খেদমত করার জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে সে অবশ্যই কোনো সময় পচা-বাসি খাবার বিক্রি করতে পারেন না। এটা আমার বিশ্বাস।

ভালো থাকুক এই ভালো মানুষগুলো এবং তাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক আমাদের দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা।’

 

টাইমস/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ওসমান হাদির মৃত্যুর সংবাদ সত্য নয়: ইনকিলাব মঞ্চ Dec 18, 2025
img
বাংলাদেশে ভারতের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে ঢাবিতে আজাদী মিছিল Dec 18, 2025
img
ওসমান হাদির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন, আমরা আশাবাদী ভাই ফিরবেন: ফাতিমা তাসনিম জুমা Dec 18, 2025
img
মেহজাবীনের বিরুদ্ধে অভিযোগের মামলার শুনানি বৃহস্পতিবার Dec 17, 2025
img
২০২৬ ফুটবল বিশ্বকাপের রেকর্ড প্রাইজমানি ঘোষণা ফিফার Dec 17, 2025
img
নিজের বিকৃত ছবি ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষুব্ধ শ্রীলীলা Dec 17, 2025
img
হাদির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন, দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার Dec 17, 2025
img
হাদির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন: প্রেস উইং Dec 17, 2025
img
ইমরান খানের সঙ্গে দেখা করতে জানুয়ারিতে পাকিস্তানে ফেরার পরিকল্পনা দুই ছেলের Dec 17, 2025
img
পৃথক স্মরণসভা নিয়ে এবার মুখ খুললেন দেওল ঘনিষ্ঠ মনোজ দেশাই Dec 17, 2025
img
শিল্পা শেঠির রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ম্যানেজার Dec 17, 2025
img
চব্বিশের ডামি প্রার্থীরা যেন ভোটে অংশ নিতে না পারেন: ইসিকে লিগ্যাল নোটিশ Dec 17, 2025
img
ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল সৌদি আরব Dec 17, 2025
img
কৃষকের ১১৭টি আমগাছ কেটে নিল দুর্বৃত্তরা Dec 17, 2025
img
বিয়ের আগে ব্যাচেলর পার্টি করতে শ্রীলঙ্কায় রাশমিকা! Dec 17, 2025
img

আইপিএল নিলাম

দল পাওয়া নিয়ে নাটকীয়তা, সুযোগ পেয়ে বললেন ‘নতুন জীবন পেলাম’ Dec 17, 2025
img
প্রাক্তন স্ত্রীর কাছে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ চাইলেন কুমার শানু Dec 17, 2025
img
‘রাজাকার’ বয়ানে হাসিনার পতন, আবারও এই ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে: হেফাজত Dec 17, 2025
img
নিজের বিচার সরাসরি সম্প্রচারের দাবি ইনুর Dec 17, 2025
img
আমার গানের গলার ক্রেডিট শাবনূরকেই দিতে চাই : কনকচাঁপা Dec 17, 2025