জীবনে একবার হলেও দেখে আসুন হাওর 

বর্ষাকাল এলেই কেমন হাত-পা কোলে করে অলস সময় কাটাতে ইচ্ছে করে। কবি গুরুর কবিতার ওই নিষেধ বাণীকে নমস্য ধরে নিয়ে ঘরে বসে থাকতে মন চায়। গ্রাম তো বটেই শহুরে তারুণ্যও শুয়ে-বসে টিভি দেখে আর ভুনা খিচুড়ি খেয়ে সময় কাটিয়ে দেয়। অথচ একটু ঝুঁকি নিলেই কিন্তু জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর আর দুর্লভ কিছু মুহূর্ত যোগ হতে পারে আপনার জীবনে। ভাবছেন কোথায় গেলে পাবেন সেই মুহূর্ত? কে দেবে এত রোমাঞ্চ?

তাহলে শুনে নিন। আপনাকেই হাতছানি দিয়ে ডাকছে অথৈ জলের হাওর। এই ভরা বর্ষায় কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম গেলে দেখা পাবেন এক অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির। হয়তো এমন প্রকৃতি আপনার জীবনে প্রথমও হতে পারে। এমনও হতে পারে হাওরের বিশাল জলরাশি আপনার চিন্তার জগতে নিয়ে আসতে পারে ছোটো-খাটো কিছু পরিবর্তন। আপনাকে করতে পারে আগের চেয়ে উদার, মানবিক, কল্পনাবিলাসী, অনুভূতি পরায়ণ কিংবা সৃষ্টিকর্তার প্রতি আরো অনুগত।

কেননা, চারিদিকে থৈ থৈ জলরাশি আর মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো ছোট ছোট গ্রাম, দুয়েকটি বাড়ি আর কোথাও কোথাও নিঃসঙ্গ হিজল গাছে যে কত প্রকার বার্তা থাকে তা কেবল মনই জানে। সেই অনুভূতি নগরে বসে কখনোই মিলবে না। বর্ষায় অষ্টগ্রাম রূপবতী। রূপ-লাবণ্য ছড়ায় হাওর দ্বীপের গাছ-পালা, পশুপাখি, পানির নিচের ডুবন্ত সড়ক, অবসর যাপনে ছেলে-বুড়োদের মাছ ধরা, দূর থেকে দেখা কোনো কোনো সেতু,কিংবা দিগন্ত রেখার সঙ্গে মিলিয়ে যাওয়া ধুধু প্রান্তর, নাম না জানা কোনো গ্রাম। তাইতো জীবনে অন্তত একবার হলেও ঘুরে আসুন সঙ্গীদের নিয়ে।

ঢাকা থেকে যেতে হলে অন্তত চারজনের একটি ছোট্ট দল করুন। বৃহস্পতিবার অফিস সেরে সন্ধ্যা নাগাদ কমলাপুর থেকে চেপে বসুন এগারসিন্দুর ট্রেনে। তবে হ্যাঁ, যাওয়ার আগে রাত যাপনের জন্য কুলিয়ারচরে হোটেল কিংবা ডাকবাংলোটা বুকিং করে রাখবেন। এখানে থাকার হোটেলের মান খুব ভালো না হলেও একটি রাত যাপনের জন্য খারাপ হবে না। এতে করে শুক্রবার ভোর থেকেই আপনি হাওর দেখার সুযোগ পাবেন। আর যদি শুক্রবার যেতে চান তবে গুলিস্তান থেকে কিশোরগঞ্জগামী বিআরটিসির বাসে করেও কুলিয়ারচর নামতে পারবেন। তারপর কুলিয়ারচর থেকে স্পিড বোটে কিংবা লঞ্চে করে যাওয়া যাবে অষ্ট্রগ্রাম। স্পিডবোটে সময় লাগবে ৪০ থেকে ৫০ মিনিট। আর লঞ্চে গেলে সময় লাগবে ঘণ্টা তিনেক। তবে যাদের পানিতে ভয় তাদের লঞ্চে যাওয়াই ভালো।

অষ্টগ্রাম যাওয়ার পথে এখন কোনটা নদী আর কোনটা হাওর বোঝার উপায় নেই। এখন মনে হবে পুরোটাই যেন সমুদ্র। তবে মাঝে মাঝে দ্বীপ গ্রামগুলো দেখে আশ্বস্ত হবেন যে না সামনে লোকালয়ই রয়েছে। যেতে যেতে ছোট বড় অনেক ঢেউ আপনার বুকে শিহরণ জাগাবে। স্পিডবোটে গেলে কোনো নড়াচড়া না করে স্থির হয়ে বসে থাকবেন। কারণ একটু বেখেয়ালে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা তো রয়েছেই।

অষ্টগ্রামের হাওর আসলে মিশেছে হবিগঞ্জ-নেত্রকোনার হাওরের সঙ্গে। বেশ কয়েকটি ছোট বড় নদী ভাটি থেকে নেমে মিশেছে মেঘনায়। তাই তো ঢেউয়ের তারতম্য রয়েছে জায়গায় জায়গায়। মাঝে মাঝে জেলেদের মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম চোখে পড়বে। চোখে পড়বে যাত্রীবাহী স্পিডবোট, লঞ্চ, নৌকা। দূর থেকে দেখে মনে হবে দূরের কোনো বন্দরের উদ্দেশে ছুটে চলছে একদল নাবিক। পাল তোলা নাওয়ে কোনো না কোনো ভ্রমণ পিয়াসী।

অষ্টগ্রাম হাওর বেষ্টিত হলেও এটি প্রাচীন একটি জনপদ। ভাটির দেশে মাটির দেখা পাবেন অনেক পর পর। দ্বীপগ্রামগুলো জনবসতিতে ঠাসা। যেইটুকু মাটি যেন তার সবটুকুই খাঁটি। আর যতটুকু এখানে জল তার সবটুকু সফল এই জনপদবাসীদের জন্য। কেননা এই জলেই ফসলের হাসি, এখানেই মাছ-হাঁস সবকিছু। বাড়িঘরগুলো দেখলে মনে হবে এখানকার মানুষ বেশ অবস্থাপন্ন। হাওরের বাঁধের পাশে রঙিন দোতলা-তিনতলা বাড়ির কারুকার‌্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। আর পানির ওপর ভাসমান স্কুল-কলেজ কিংবা সাইক্লোন শেল্টারগুলো আপনাকে দেবে একটি উন্নয়নমুখী বাংলাদেশের ধারণা।

অষ্টগ্রাম উপজেলার আয়তন ৩৩৫ বর্গকিলোমিটার। প্রাচীনকালে অষ্টগ্রাম, আসিয়া, দুবাই ভাটেরা, নরসিংহপূর্ববাদ, খাসাল, বীরগাঁও, বত্রিশগাঁও এবং বারেচর এই আটটি মৌজার সমন্বয়ে গঠিত জনপদের নাম অষ্টগ্রাম। ইউনিয়ন সংখ্যাও আটটি।

অষ্টগ্রামে সাম্প্রতিককালের উন্নয়ন কর্মসূচিতে গুরুত্ব পেয়েছে সড়ক যোগাযোগ। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের এলাকা হওয়ায় উঁচু উঁচু রাস্তা, সেতু নির্মাণ হচ্ছে। রয়েছে সাবমারসিবল সড়ক। বর্ষাকালে পানির নিচে তলিয়ে থাকা এ সড়ক দিয়ে ইজিবাইকে চলাচল করা যায় কোথাও কোথাও। বর্তমানে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের সঙ্গে সদরের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী নিকলি ও বাজিতপুরের সঙ্গেও সড়ক যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।

অষ্টগ্রামে থাকার তেমন ভালো কোনো আবাসিক হোটেল নেই। তবে উপজেলা প্রশাসনের ডাকবাংলোটি বেশ সুন্দর। আগে থেকে যোগাযোগ করে নিলে অল্প খরচে থাকা যাবে। বাংলোর জানালা দিয়ে পেছনের হাওরের রূপ যতটুকু দেখা যাবে তাতেই আনন্দে ভরে যাবে মন। ঝুম বৃষ্টি কিংবা ঝলমলে রোদ যাই থাকুক না কেন ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধরা দেবে জলকন্যা হাওর।

খাবারের জন্য বাজারের বাবুল বাবুর্চিকে পাওয়া যাবে। আগেভাগে যোগাযোগ করলে তিনি আপনাদের জন্য হাওরের সুস্বাদু মাছ দিয়ে ভুরিভোজের আয়োজন করবেন। তবে ভালো হয় যদি বাংলোর আইনুদ্দিনকে ম্যানেজ করতে পারেন। কেননা রান্নার ব্যবস্থাও আছে সেখানে। ইচ্ছে মতো বাজার করে রান্নার ব্যবস্থাও করতে পারেন চাইলে। এছাড়া বাজারে কয়েকটি ছোট খাটো হোটেল রয়েছে। সেখানে দুয়েক বেলা খেলে মন্দ লাগবে না।

দুপুরের খাওয়া শেষে আপনি একটি ইজিবাইক ঠিক করে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ুন। হজরত কুতুব উদ্দিনের মাজার-মসজিদ, মেঘলা দিঘি, ইকুরদিয়া ঘাট দেখা হলে এবার সাবমারসিবল কোনো সড়কে চলে যান। পানির ভেতর দিয়ে হেটে যতদূর মন চায় যান। তারপর দলবেঁধে দাঁড়িয়ে গলাছেড়ে গান ধরুন। না পারলে বিশাল জলরাশিকে স্বাক্ষী রেখে শুরু করুন বক্তৃতা- দেখবেন জীবনে এর চেয়ে আনন্দ আর নাই। দিগন্তের ওপারে লাল আভা নিয়ে যে সূর্য ডুবুডুবু তাকে স্বাক্ষী রেখে নীড়ে ফিরে আসুন। মনে মনে ধন্যবাদ দিন সৃষ্টিকর্তাকে যিনি আপনাকে মৃত্যুর আগে অন্তত একবার হলেও হাওর দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন।

বাংলোয় ফিরে পাশের পুকুরে ডুবিয়ে গোসল করুন। তারপর হেলিপ্যাড ধরে হেঁটে আসুন রুমে। দেখবেন শরীর ঝরঝরে-হালকা অনুভূত হচ্ছে। সন্ধ্যায় বাজারে ঘুরতে বেরিয়ে হালকা নাস্তা সেরে নিন। মন চাইলে বাঁধের কোথাও বসেও সময় কাটাতে পারেন। অথব বাংলোর কক্ষেও হতে পারে চমৎকার আড্ডা। রাতে শহরের পাশের লম্বা সেতুতে গিয়ে হাওরের আকাশ উপভোগ করতে ভুলবেন না। নিচে পানি ওপরে চাঁদ এ এক ভয়ংকর সুন্দর হাওর। এ সৌন্দর্য কোনো ক্যানভাসে আঁকা যায় না।

বাইরে খেলে রাত ৯ টার মধ্যেই সেরে নিবেন। তারপর ঘুরে ফিরে ১০টা নাগাদ রুমে ফিরে পরদিন সকালেই ধরতে পারেন ঢাকার পথ। সকালে বাজারের কোনো হোটেলে হালকা নাস্তা সেরে স্পিডবোটে করে ফিরে আসতে পারেন কুলিয়ারচর। তবে ফিরতি হাওরের স্রোত অনুকূলে থাকবে। পথে সময় লাগবে কিছুটা কম। আসার পথ যতই পেছনে ফেলবেন অষ্টগ্রামের জন্য এক অদৃশ্য টান অনুভূত হবে। এ টান আর কিছু নয়, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের টান। এক অসম্ভব মায়া। এ মায়া পানির জন্য, বিশাল আকাশের জন্য। কুলিয়ারচর এসে দুপুর দেড়টার ট্রেন ধরুন। কিংবা বাসে করে চলে আসুন ঢাকায়।

যেভাবে যাবেন: সবচেয়ে ভালো হলো ট্রেনে যাওয়া। প্রতিদিন সকাল ৭টা ও সন্ধ্যে ৬.৪০ মিনিটে এগারসিন্দুর ট্রেনটি (বুধবার বন্ধ) ছাড়ে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে। এতে উঠে কুলিয়ারচর নেমে পড়ুন। ভাড়া ১২০ টাকা।এ ছাড়া গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া থেকে বিআরটিসি বাসে করেও কুলিয়ারচর যাওয়া যায়। ভাড়া ২০০ টাকা। যারা ভৈরব হয়ে যেতে চান, তারা ভৈরব নেমে সিএনজিতে করে কুলিয়ারচর যাবেন। শেয়ারে ভাড়া নেবে জনপ্রতি ৪০ টাকা।

কুলিয়ারচর নেমে একটা রিকশা নিয়ে চলে যান লঞ্চঘাট। এখান থেকে প্রতিদিন সকাল ৬টা, ৮টা, ৯টা, ১১টা এমনি করে ৩টা পর্যন্ত লঞ্চ ছেড়ে যায় অষ্টগ্রাম। ভাড়া ৯০ টাকা। সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘণ্টা। স্পিডবোটে ‍কুলিয়ারচর থেকে ভাড়া জনপ্রতি ১২০ টাকা।

 

লেখক: মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক

 

টাইমস/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ

img
দূষণের কারণে বছরে পৌনে ৩ লাখ বাংলাদেশির মৃত্যু Mar 28, 2024
img
আইএমএফের হিসাবে দেশের রিজার্ভ এখন কত, জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক Mar 28, 2024
img
প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার হিসেবে আইসিসির এলিট প্যানেলে সৈকত Mar 28, 2024
img
বিশ্বে প্রতিদিন ১০০ কোটি টন খাবার নষ্ট হয় : জাতিসংঘ Mar 28, 2024
img
জাহাজসহ জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে সরকার অনেক দূর এগিয়েছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী Mar 28, 2024
img
ঢাবির কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটের ফল প্রকাশ, ৮৯.৯৩ শতাংশ ফেল Mar 28, 2024
img
একনেকে ৮ হাজার ৪২৫ কোটি টাকার ১১ প্রকল্প অনুমোদন Mar 28, 2024
img
রাজসিক সংবর্ধনায় দায়িত্ব নিলেন বিএসএমএমইউ'র নতুন উপাচার্য Mar 28, 2024
img
রোদে পোড়া ত্বকের যত্নে হলুদের ঘরোয়া প্যাক Mar 28, 2024
img
শহরের চেয়ে গ্রামে বিয়ে-তালাক বেশি Mar 28, 2024