লিটমাস টেস্টের ফল কী বার্তা দিচ্ছে?

ছাত্রদলের একের পর এক ভরাডুবি বিএনপিকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে! যদিও এটা কোনো জাতীয় নির্বাচন নয়, তবে এর প্রভাব বা গুরুত্ব জাতীয় নির্বাচনে ছোট হোক বা বড় হোক, একটি ফ্যাক্টর। অন্তর্বর্তী সরকারও যে চিন্তামুক্ত, তা বলা যাচ্ছে না। কারণ, নির্বাচন বর্জন বা নির্বাচনের সময় যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে আগামী জাতীয় নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে হলে অনেকগুলো হিসাব কষে রাখতে হবে। কিছু বিষয় ধরে কথা বলি।

ছাত্রদলের দুর্বলতা ও কারণ

প্রথমত, ছাত্রদল এই মুহূর্তে শক্তিহীন। ডাকসু এবং জাকসুর লিটমাস টেস্টে সেটা স্পষ্ট হয়েছে। তারা আশঙ্কাজনকভাবে সমর্থন হারিয়েছে। ছাত্রদল কেন পরাজয়ের যে নিম্নতম সীমা, তারও নিচে নেমে গেল? আমরা দেখেছি, ছাত্রশিবির তাদের প্যানেলে যেসব চমক ও নতুনত্ব আনতে পেরেছে, সেই তুলনায় ছাত্রদল পারেনি। শিক্ষার্থী-কল্যাণে যেসব কাজ করা দরকার, সেগুলো তাদের নেই। ছাত্রদলের সমর্থনে স্পষ্ট ভাটা! এই প্রজন্ম পেশিশক্তির ন্যূনতম ব্যবহারও পছন্দ করে না। সেদিন টিমের সাথে ডাকসু কাভারেজে দেখলাম, ভিপি প্রার্থী আবিদ কেন্দ্রের দরজায় সজোরে ধাক্কা দিচ্ছেন ভেতরে চলে যাবেন বলে। ওই সময় ভোট গণনা চলছিল, তাই প্রার্থীর সদলবলে ভেতরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না! ভেতরে প্রার্থীর এজেন্টরা ছিলেন।

আবার প্রচার-প্রচারণায় প্রতিপক্ষ নিয়ে যে বিষয়গুলো বলা দরকার, সেগুলো না বলে তারা পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছেন। জামায়াত-শিবির নিয়ে ১৯৭১ বা স্বাধীনতা ইস্যু এই প্রজন্মের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, আইনি বা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় এটা দিয়ে তাদের পরাজিত করা যাবে না। শেখ হাসিনা সেটা করতে গিয়ে জামায়াত-শিবিরকে যে পরিমাণ শক্তি দিয়েছেন, সেই শক্তির ঠেলা তো মাত্র টের পাওয়া গেল! জামায়াতের 'ইনক্লুসিভ পলিটিক্স' নিয়ে আপনি অন্তত ১০০টা প্রশ্ন তুলতে পারেন, কিন্তু অনেকেই সেই জায়গাটা স্পর্শ করে না। তাদের ধর্মীয় রাজনীতির বৃত্তায়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়- সেরকম প্রশ্ন আমরা দেখি না। যেটা করে, সেটা ওই ঘুরেফিরে '৭১! এই চেতনা বিক্রি করে অন্তরালে দেশ বিক্রি হয়ে যাচ্ছিল। জনতার গণঅভ্যুত্থান দেশকে রক্ষা করেছে!

যারা নতুন প্রজন্ম; যারা জেন জেড; তাদের ভাষা, মতামত ও চিন্তাকে বুঝতে শিখুন। রাজনীতিতে বিভক্তির দেয়াল তুলে এগিয়ে যাওয়া কঠিন! অথচ বিএনপি মাঝেমধ্যে এখানেই আটকে যায়!

ছাত্রদলে নেতৃত্ব সংকট

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-ছাত্রদলে কারা আছে। আমার মনে হয়, ২৫ বছরের বেশি বয়স হলে তাদের ছাত্রদলে রেখে দলেরই ক্ষতি হয়। অছাত্র অথবা বয়স্ক নেতা একটা ছাত্র সংগঠনে বেমানান! আপনি যদি অন্যান্য সংগঠনের বয়স দেখে বিচার করেন, তাহলে এই বয়সের কারণে ছাত্রদলের মান নিচের দিকে চলে যায়।

আবিদ, হামিম, মায়েদের মতো আরও নেতা খুঁজুন। তারা পরাজিত বলে তাদের ওপর দায় চাপাবেন না। দায়টা বিএনপি এবং ছাত্রদলের। যতটুকু ভোট এসেছে, সেগুলো আবিদ, হামিম, মায়েদ বা মীমদের কারণে, নতুবা পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হতো। তাদেরকে সেই পুরনো পথে পরিচালিত করবেন না।

আমার মাঝে মাঝে অবাক লাগে, বিএনপি বা ছাত্রদলে এমন অনেক প্রতিভাবান আছেন, যাদেরকে সামনে আনা হয় না। অথবা টেম্পুস্ট্যান্ড পলিটিক্সে তারা গা ভাসায় না, কিন্তু তারা দলের সম্পদ। অথচ আপনি তাদের চিনবেনই না।

আপনি বা আপনারা কি ফারহান আজিমকে চেনেন? নোয়াখালীর একটি আসনের বিএনপির একাধিকবার নির্বাচিত এমপির ছেলে। বহু গার্মেন্টসের মালিক হয়েও জ্যামে পড়ে সময় নষ্ট হবে বলে পাঠাও চড়ে অফিসে চলে যান তিনি। শোডাউন পলিটিক্সের নোংরামিতে তাকে দেখা যায় না। আমি জানি না তিনি সামনে প্রার্থী হবেন কিনা, তাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে কিনা। 

ধানমন্ডির শামীম আশরাফিকে চেনেন? বয়স একেবারে কম। এখন যুবদলের নেতা। সামনের সারির পোস্টে নেই। সংগঠিত করার যে শক্তি তার মধ্যে দেখেছি, সেটা না ছাত্রদল কাজে লাগিয়েছে, না এখন যুবদল কাজে লাগাচ্ছে। অথচ যুবদলের যেসব মুখ আপনার চোখের সামনে পড়বে, সেগুলো দেখলে সাধারণ মানুষ কাছে আসবে না।

সাঈদ ইব্রাহিমকে তো অনেকে চেনেন না। অর্থনীতি নিয়ে তার ভাবনা ফেসবুকে দেখলেই ইংরেজি দৈনিকগুলো তা কেড়ে নিয়ে প্রকাশ করে। আমি নিজে পড়ি। আমি জানি না তাকে বিএনপি কতটা কাজে লাগাতে পারবে। সাঈদ ইব্রাহিম যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদের ছেলে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার চিন্তাভাবনা এই প্রজন্মের।

ডালিয়াকে তো ছাত্রদল কাজে লাগায়নি। মেয়েটি এখন ঠিক কোথায় আছে, আমি জানি না। ২০১৯ সালে তাকে রাস্তায় দেখেছিলাম।

ওই সময় খালেদা জিয়া যখন শেষবারের মতো রাস্তায়। গুলশান থেকে তার গাড়ি পুরান ঢাকার দিকে যাচ্ছে। আদালতের রায়ের পর আর ফিরবেন না খালেদা। খালেদা জিয়া যে ফিরছেন না, জেলেই যাচ্ছেন, সেটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।

সেই সময়ে তার গাড়িবহর ঘিরে বিএনপি-ছাত্রদল শক্তি তৈরি করতে পারত, কিন্তু পারেনি। একটি মোটরসাইকেলে একাই ডালিয়া পুরান ঢাকার আদালত পর্যন্ত গিয়েছিল। ওই বয়সী আর ছাত্রদল নেতা তেমন একটা দেখিনি। কারণ, তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে নেই, তাই হারিয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। ছাত্রদল আবু সাঈদ তৈরি করতে পারেনি ওই সময়। আবু সাঈদের মতো মানুষরা পরে তৈরি হয়েছে, যারা ২০২৫ সালে জীবন দিয়ে বাংলাদেশকে বাঁচিয়েছে। আজকের বাংলাদেশের যে নতুন স্বাধীনতা বা নতুন বাংলাদেশ দেখেন, তার প্রথম শহীদ হিসেবে রংপুরের আবু সাঈদকে অভিহিত করা হয়।

নতুন প্রজন্ম ও তারেক রহমানের চ্যালেঞ্জ

বিএনপির যে আশঙ্কা এখন, সেটা থেকে উত্তরণের জন্য তারা এই বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিতে পারে। ২০০০ সালের দিকের ভোটার আর আজকের ২০২৫ সালের ভোটার এক নয়। লন্ডনে তারেক রহমান যে ভাবনা পোষণ করেন, যে বার্তা দিতে চান, সেটা বিএনপির তৃণমূলে পৌঁছায় না। কিছুদিন পর যখন তারেক রহমান ফিরবেন, তখন তাকেই নিঃসন্দেহে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। শেখ হাসিনা যখন দেশ ছেড়ে পালান, সে সময় তারেক রহমানের প্রথম বক্তব্য কী ছিল জানেন, 'পরাজিতরা বিজয়ীদের কাছে যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে সেই বিজয় আনন্দের হয় না'। অথচ এরপর দখল-পাল্টা দখল দেখা গেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব কতটা, সেটা এই লিটমাস টেস্টে ধরা পড়েছে। দেশের রাজনীতি আর নতুন বাংলাদেশের সন্ধিক্ষণ একটি সম্ভাবনাময় সময় পার করছে। এই সম্ভাবনা যে দল তার থলেতে আনতে পারবে, তাদের পরিসর বিস্তৃত হবে।

লেখক: সাব্বির আহমেদ, মোবাইল জার্নালিজম এডিটর-ইন-চিফ, বাংলাদেশ টাইমস।
ইমেইল: editor@bangladeshtimes.com

টিকে/

Share this news on:

সর্বশেষ

img
গুরবাজের দুর্দান্ত ব্যাটিং, জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করল আফগানিস্তান Nov 02, 2025
ভিন্নধর্মী গল্প নিয়ে আসছে ‘দম’ Nov 02, 2025
img
ট্রাম্প জানেন না, কাল কী করবেন : ভারতের সেনাপ্রধান Nov 02, 2025
একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ অস্বীকার করলো জামায়াত Nov 02, 2025
img
নিজ দেশেই হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে উসকালেন শান্তিতে নোবেলজয়ী মাচাদো Nov 02, 2025
img
ঠিক সময়ে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে সন্দেহ তারেক রহমানের Nov 02, 2025
img
জলাবদ্ধতা নিরসনে এক বছরে অগ্রগতি ৫০ শতাংশ : চসিক মেয়র Nov 02, 2025
img
সুশাসন চাইলে যোগ্য লোকের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে: মাসুদ সাঈদী Nov 02, 2025
img
শাহরুখের সাম্রাজ্য সামলানোর জন্য কত কোটি পারিশ্রমিক পান পূজা? Nov 02, 2025
img

নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৫

ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২৯৯ রানের টার্গেট দিল ভারত Nov 02, 2025
img
প্রেমিকার জন্মদিনে আবেগী ও রোমান্টিক বার্তা হৃতিক রোশনের Nov 02, 2025
img
মেয়ের জন্মদিনে কাঞ্চন মল্লিকের আবেগঘন বার্তা Nov 02, 2025
img
জকিগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফের অনুপ্রবেশ, স্থানীয়দের ধাওয়া Nov 02, 2025
img
৫২ বছর বয়সেও কোটি ভক্তের হৃদয়ে ঐশ্বরিয়া Nov 02, 2025
img
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ফেব্রুয়ারিতেই অমর একুশে বইমেলা Nov 02, 2025
img
মান্নতে আসছেন না শাহরুখ, হতাশ হাজারো ভক্ত Nov 02, 2025
img
ডা. শফিকুর রহমানকে মোবারকবাদ ও শুভেচ্ছা চরমোনাই পীরের Nov 02, 2025
img
খাবারের খোঁজে দুই দিন ধরে রাস্তায় ঘুরছিলেন শাহরুখ! Nov 02, 2025
img
অন্য দেশের ‘সরকার বদলের’ মার্কিন নীতি শেষ : তুলসী গ্যাবার্ড Nov 02, 2025
img
এল ক্লাসিকোয় এমবাপ্পের পেনাল্টি মিস দেখে প্রাণ গেল রিয়াল সমর্থকের Nov 02, 2025