ইসরায়েলি বাহিনী গাজামুখী ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র ১৩টি নৌযান আটকা করেছে। এদিকে প্রায় দুই ডজন নৌযান এখনো গাজার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এর মধ্যে একটি জাহাজ ইতোমধ্যে গাজার আঞ্চলিক জলসীমায় প্রবেশ করেছে। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য ফ্লোটিলা কর্তৃপক্ষ সরাসরি সম্প্রচারের (লাইভ ভিডিও) ব্যবস্থা চালু করেছে, যাতে বিশ্ববাসী দেখতে পারে।
ইসরায়েল এর আগে গাজামুখী এই নৌবহরকে থামিয়ে দেবে বলে হুমকি দিয়েছে। দেশটির দাবি, কর্মীরা নাকি ‘বৈধ নৌ অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করছে।’ তবে আন্তর্জাতিক আইন পরিষ্কারভাবে বলছে, মানবিক সহায়তা গন্তব্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া যায় না। এ ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের এই কর্মকাণ্ড নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে।
গাজার উদ্দেশে যাওয়া ত্রাণবাহী ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র নৌযানগুলোতে থাকা আইনজীবীরা ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও সামুদ্রিক আইন লঙ্ঘনের তথ্য নথিভুক্ত করছেন। আল জাজিরার সাংবাদিক হাসান মাসউদ বহরের একটি জাহাজে আছেন। তিনি জানিয়েছেন, এই নথিগুলো জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালতে পাঠানো হবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা সব ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করছি এবং নিশ্চিত করতে পারছি যে ,এখনও কয়েকটি নৌযান গাজার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
অন্তত একটি জাহাজও যদি গাজায় পৌঁছায়, তবে অবরোধ ভাঙার মূল লক্ষ্য পূরণ হবে।’ হাসান আরো জানান, ইতালির সিসিলি থেকে আরেকটি ফ্লোটিলা গাজার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, কর্মীরা গাজার ক্ষুধার্ত জনগণের কাছে খাদ্য, পানি ও ওষুধ পৌঁছে দিতে এবং ইসরায়েলের পূর্ণ অবরোধ বিশ্ববাসীর নজরে আনতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গাজাগামী নৌবহর আটকানোর ঘটনায় আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তুরস্ক, স্পেন ও ইতালি। প্রয়োজনে নিজেদের নাগরিকদের সহায়তায় তারা নৌযান বা ড্রোন পাঠানোর প্রস্তুতি নিয়েছে।
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরায়েলের হামলাকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, এটি নিরীহ সাধারণ মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছে। ইস্তাম্বুলের প্রধান প্রসিকিউটর কার্যালয় জানিয়েছে, আটক ২৪ জন তুর্কি নাগরিকের ঘটনায় তদন্ত শুরু করা হয়েছে। তদন্তের অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে—অবৈধভাবে আটক রাখা, পরিবহনযান জব্দ করা এবং সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত করা।
ব্রাজিল: শান্তিপূর্ণ কর্মীদের ওপর হামলা নিন্দনীয়
ব্রাজিলও ইসরায়েলি নৌবাহিনীর হামলার নিন্দা জানিয়েছে। আটক যাত্রীদের মধ্যে ব্রাজিলের সংসদ সদস্য লুইজিয়ানে লিন্সসহ ১৫ জন ব্রাজিলীয় নাগরিক ছিলেন। ব্রাজিলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ইসরায়েল সরকারের সামরিক পদক্ষেপ মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং শান্তিপূর্ণ কর্মীদের শারীরিক নিরাপত্তা বিপন্ন করছে। এখন আটককৃতদের নিরাপত্তার দায় ইসরায়েলের।’ এর আগে ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌরো ভিয়েরা জানান, তার সরকার সরাসরি ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ব্রাজিলীয় নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। ব্রাজিলসহ অনেক দেশই গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে বাধা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
পাকিস্তান: ‘এটি একটি ঘৃণ্য হামলা’
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ইসরায়েলের হামলাকে ‘একটি ঘৃণ্য আক্রমণ’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আটক ব্যক্তিদের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করি এবং তাদের অবিলম্বে মুক্তির আহ্বান জানাই। তাদের অপরাধ ছিল কেবল অসহায় ফিলিস্তিনিদের জন্য ত্রাণ বহন করা।’
ম্যানডেলা পরিবারের আহ্বান
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি ম্যানডলা ম্যান্ডেলা একটি ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন, তার নৌযানটির কাছে ইসরায়েলি নৌবাহিনীর জাহাজ এগিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা আপনাদের সরকারকে চাপ দিন, যাতে আমাদের গাজার দিকে নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করা হয়।’
ফিলিস্তিনি নেত্রী: ‘এটি জলদস্যুতা’
ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদ ও কর্মী, এবং ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য হানান আশরাওয়ি বলেছেন, আন্তর্জাতিক জলসীমায় গাজার ত্রাণবাহী নৌবহরে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল একটি ‘অপরাধমূলক জলদস্যুতা’ করেছে। তিনি ত্রাণ বহরের কর্মীদের ‘সাহসী নারী-পুরুষ’ আখ্যা দিয়ে বলেন, তারা ইসরায়েলের গণহত্যা ও অবৈধ অবরোধকে চ্যালেঞ্জ করছেন। আশরাওয়ি আরো বলেন, ‘তারা নিজের জীবন বাজি রেখে সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করছে, সংহতির প্রকৃত অর্থ ও মানবিক সহমর্মিতা প্রদর্শন করছে।’
কলম্বিয়ার : ইসরায়েলি কূটনীতিকদের বহিষ্কার
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো বুধবার ঘোষণা করেন, গাজাগামী ত্রাণবাহী বহরে হামলা ও দুই কলম্বিয়ান নারী কর্মীকে আটক করার ঘটনায় দেশটিতে থাকা ইসরায়েলের সবশেষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হচ্ছে। তিনি জানান, আটক হওয়া দুই কলম্বিয়ান নারী ম্যানুয়েলা বেদোয়া ও লুনা বারেত্তো গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার অংশ ছিলেন এবং ফিলিস্তিনের প্রতি মানবিক সংহতির কাজে অংশ নিয়েছিলেন।
পেত্রো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ লেখেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নতুন করে একটি ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ করেছেন, তাই বোগোতায় অবস্থানরত ইসরায়েলের পুরো কূটনৈতিক প্রতিনিধিদলকে বহিষ্কার করা হয়েছে। একই সঙ্গে, তিনি ২০২০ সালে কার্যকর হওয়া ইসরায়েলের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তিও বাতিল করেন। পেত্রো দীর্ঘদিন ধরেই নেতানিয়াহুর কড়া সমালোচক।
তিনি নেতানিয়াহুকে ‘গণহত্যাকারী’ এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ‘গণহত্যার সহযোগী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। গত সপ্তাহে তিনি নিউইয়র্কে ফিলিস্তিনপন্থি এক বিক্ষোভে অংশ নিয়ে মার্কিন সেনাদের ট্রাম্পের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করার আহ্বান জানান। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য দাবি করেছে, নৌবহরের কয়েকটি জাহাজকে নিরাপদে থামানো হয়েছে এবং যাত্রীদের একটি ইসরায়েলি বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
স্পেন: ইসরায়েলি দূতকে তলব
স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসে ম্যানুয়েল আলবারেস বৃহস্পতিবার জানান, গাজাগামী ত্রাণবাহী নৌবহর আটকানোর ঘটনায় মাদ্রিদে ইসরায়েলের সর্বোচ্চ কূটনীতিককে তলব করা হয়েছে। তিনি বলেন, বহরে ৬৫ জন স্প্যানিশ নাগরিক ছিলেন। উল্লেখ্য, গত বছর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ইসরায়েল তাদের রাষ্ট্রদূতকে মাদ্রিদ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজাগামী আন্তর্জাতিক ত্রাণবাহী নৌবহর আটকানোর ঘটনায় তারা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা সংশ্লিষ্ট ব্রিটিশ নাগরিকদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। বহরে বহন করা ত্রাণ অবশ্যই নিরাপদে গাজায় পৌঁছে দিতে স্থানীয় মানবিক সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা উচিত।’
অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে, গাজামুখী বহরে বিদেশি কর্মীদের আটক করার খবর তারা অবগত হয়েছে এবং জাহাজে থাকা নিজেদের নাগরিকদের সহায়তা দিতে প্রস্তুত। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা সব পক্ষকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানাই এবং সংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তা ও মানবিক আচরণ নিশ্চিত করার দাবি জানাই।’
এবি/টিকে