জিল্লুর রহমানের বিশ্লেষণ

আবারও ভেল্কিবাজি, রাজনীতিতে কালো ছায়া

আইসিটি আইনের নতুন ২০ (সি) ধারা নিয়ে আলোচনা করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও উপস্থাপক জিল্লুর রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইসিটি আইনের নতুন ২০(সি) ধারা অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের মুহূর্ত থেকেই কেউ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।

স্থানীয় সরকার, সরকারি চাকরি বা জাতীয় সংসদ, কোনো ক্ষেত্রেই নয়। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নেবে কি নেবে না, তার আগেই এই অযোগ্যতা কার্যকর হবে।

গেজেট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিধানটি বলবৎ হবে। এটাই এখন দেশের আইন।

শনিবার (১১ অক্টোবর) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে এ প্রসঙ্গে জিল্লুর রহমান বিস্তর আলোচনা করেছেন।

জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ফৌজদানি, নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব একসঙ্গে বিবেচনা না করলে এর গুরুত্ব বোঝা সম্ভব নয়।

প্রথমত, এই বিধান মানুষের নির্দোষ থাকার অধিকারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে। অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশে জনপ্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা হারানোর সীমা নির্ধারিত হয় দণ্ডবিভাগে, অর্থাৎ তদন্ত বা অভিযোগের পর্যায়েই নয়।

বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ মামলায় সংবিধানের ৪৭(ক) ধারা যোগ করে কিছু মৌলিক প্রতিকার সীমিত করা হয়েছিল। এই আইনি ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে রাষ্ট্র এখন আরো একটি ধাপ এগোচ্ছে।

প্রশ্ন থেকে যায়, এই ধাপ কি রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নাকি ন্যায়ের স্কেলে অতিরিক্ত ভার?

তিনি বলেন, রাজনীতির মাঠে এর প্রভাব ইতিমধ্যেই বড়। জুলাই-অগাস্টের অভ্যুত্থান ও অস্থিরতার পর যাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের তালিকা দীর্ঘ ও উচ্চ প্রোফাইলের। অভিযোগ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রশাসনিক নিয়োগে বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। এই ডিসকোয়ালিফিকেশন রাজনীতিতে নতুন সমস্যার সৃষ্টি করবে। দলগুলো প্রার্থী বাছাই থেকে জোট ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত হিসেব পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে।

একই ধারাবাহিকতায়, সংগঠন সমষ্টিগত দায়বদ্ধতার পথও আইনে খোলা হয়েছে। ২০ (বি) ধারা অনুযায়ী, দল বা সংগঠনের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রতীয়মান হলে ট্রাইব্যুনাল বিস্তৃত প্রতিকার দিতে পারে, কার্যক্রম স্থগিত থেকে সম্পদ বাজেয়াপ্ত পর্যন্ত।

জিল্লুর রহমান বলেন, ইতিমধ্যেই একটি বড় রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে। তাদের ছাত্রসংগঠনও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ট্রাইব্যুনাল অভিযোজনের পদক্ষেপ চলছে। রাষ্ট্র, আইন ও রাজনীতির ত্রিভুজে এটি এক ঐতিহাসিক পরীক্ষা।

তিনি বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রোডম্যাপে রাজনৈতিক দলগুলো গণভোটে নীতিগত ঐক্যমতে পৌঁছেছে। কেউ নির্বাচনের দিনেই গণভোট চায়, কেউ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে কাঠামো স্থাপন করে পরে জনগণের অনুমোদন চায়। প্রতিটি বিকল্পেরই আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতা রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের গণভোট ইতিহাসও সতর্ক করে। ১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালের তিনটি গণভোট এক প্রশ্ন-এক উত্তর মডেলে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান প্রস্তাবে একাধিক প্রশ্ন বা প্যাকেজ অনুমোদন চাইলে ব্যালট ডিজাইন ও গণনা পদ্ধতি নতুন নিয়ম দাবি করবে। ভুল হলে ফলাফল বিতর্কিত, ঠিক হলে ম্যান্ডেট দৃঢ়—মধ্যপথ নেই। আইনি সক্ষমতাও চ্যালেঞ্জ বহন করছে।

জিল্লুর রহমান মনে করেন, গণতন্ত্রের ভিত শক্ত করতে চাইলে ন্যায়বিচারের ভিত দুর্বল করা যাবে না। তবে ন্যায়বিচারের কঠোরতা যদি জনগণের ন্যায্য নিরাপত্তা চাহিদা উপেক্ষা করে, তাও টেকসই হবে না। তাই ২০ (সি) ধারা অনুযায়ী অভিযোগী অযোগ্যতার সঙ্গে অন্তত তিনটি সেফগার্ড থাকা জরুরি :

>> অভিযোগ গঠনের আগে একজন উচ্চ আদালতের বিচারক তা সংক্ষিপ্তভাবে পরীক্ষা করবেন।
>> ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শুরু না হলে অযোগ্যতা বাতিল হবে।
>> গুরুত্ব কম হলে এই ধারা মানবতাবিরোধী অভিযোগে প্রযোজ্য হবে না।

আইনে এগুলো থাকলে রাজনৈতিক অপব্যবহার কমবে।

তিনি আরো বলেন, সংগঠন দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রিন্সিপল থাকা উচিত; সমষ্টিগত শাস্তি নয়, প্রমাণিত সমষ্টিগত অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে প্রয়োগ। ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তে শর্ত, প্রমাণ এবং আপিলের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। কোর্টে জিততে হলে কেস থিওরি ও প্রমাণ লৌহদৃঢ় হতে হবে।

গণভোট প্রসঙ্গে তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, প্রথমে সাংবিধানিক আদেশ বা সমমানের নরমেটিভ ইন্সট্রুমেন্ট জুলাই সনদের অংশ হিসেবে কার্যকর ঘোষণা করুন, তারপর নাগরিক অনুমোদনের জন্য ব্যালটে নিন। এক প্রশ্ন-এক উত্তর ম্যান্ডেট যথেষ্ট। বিতর্কিত প্রশ্নগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে রেখে ভোটারকে দল বাছাইয়ের সুযোগ দিন। সংসদ গঠনের পর উন্মুক্ত বিতর্কে সাংবিধানিক সংশোধন হোক।

জিল্লুর রহমান বলেন, জনসচেতনতার রোডম্যাপও অপরিহার্য। গণভোট প্রযুক্তি নয়; এটি জনমতের নৈতিক যাচাই। ব্যালটের ভাষা সহজ হবে, ক্যাম্পেইন তথ্যভিত্তিক হবে। রাষ্ট্র ও নির্বাচন পরিচালনার কাঠামোতে নিরপেক্ষতার দৃশ্যমান প্রমাণ দিতে হবে। ইতিহাস শিক্ষা দেয়, ভুল প্রেক্ষাপটে গণভোটে জনগণ বিমুখ হয়, সঠিক প্রেক্ষাপটে নৈতিক বৈধতা দ্বিগুণ হয়। বর্তমানে রাষ্ট্র তিনটি মোড়ে দাঁড়িয়েছে, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা সবকটিকে একসঙ্গে চালাতে হবে।

এমআর/টিকে 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সাংবাদিক নূরুল কবিরকে আক্রমণের অর্থ কেউ রক্ষা পাবে না : মঞ্জুরুল আলম Dec 19, 2025
img
ইউজিসির নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত Dec 19, 2025
img
সন্ধ্যায় আসবে হাদির মরদেহ Dec 19, 2025
img
বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করল পাকিস্তান Dec 19, 2025
img
ওসমান হাদির শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়: ফরিদা আখতার Dec 19, 2025
img
বুলডোজার দিয়ে রাজশাহীতে আ.লীগের অফিস গুঁড়িয়ে দিলেন বিক্ষোভকারীরা Dec 19, 2025
img
প্রাপ্য ভালোবাসা মানেই সৃষ্টিকর্তার দয়া: রানী মুখার্জি Dec 19, 2025
img
পত্রিকা অফিসে হামলার তীব্র নিন্দা জানালেন মির্জা ফখরুল Dec 19, 2025
img
স্বর্ণ কিনবেন? জেনে নিন আজকের বাজারদর Dec 19, 2025
img
চাপের বিয়েকে অর্থহীন বললেন অভিনেতা অক্ষয় খান্না Dec 19, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্রে বিমান দুর্ঘটনায় সাবেক রেসার গ্রেগ বিফলের মৃত্যু Dec 19, 2025
img
হুমকির ঘটনায় থানায় জিডি করলেন হান্নান মাসউদ Dec 19, 2025
img
দ্রুত বিচার না হলে এনসিপি কঠোর কর্মসূচিতে যাবে : আখতার হোসেন Dec 19, 2025
img
এবার হান্নান মাসউদকে হত্যার হুমকি Dec 19, 2025
img
সম্পর্কের চেয়ে আয়োজন বড় নয়: শ্রুতি হাসান Dec 19, 2025
img
বজ্রপাতে কেঁপে উঠল দুবাইয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন 'বুর্জ খলিফা' Dec 19, 2025
img
গ্রেপ্তার নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ নেতার থানায় সেলফি, দুই পুলিশ ক্লোজড Dec 19, 2025
img
টানা ৯ দিন ধরে তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রির ঘরে Dec 19, 2025
img
ট্রাম্পের চাপে বিপাকে ভেনেজুয়েলা, বাণিজ্যসহ সব কার্যক্রমে প্রভাব Dec 19, 2025
img
চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন ভবন থেকে সাড়ে ৪ কোটি টাকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার Dec 19, 2025