সরকার লালন উৎসব পালন করে প্রশংসা পেয়েছিল। সেই কৃতিত্বই নষ্ট হলো আবুল সরকারকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে। শাহ আলী মাজারের গাছ কাটার প্রতিবাদে যখন আমি দাঁড়াই, আমার পাশে ছিলেন আবুল সরকার। তাই তাকে গ্রেপ্তার করা মানে আমাকে গ্রেপ্তার করা।
সোমবার (২৪ নভেম্বর) রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাউলশিল্পী আবুল সরকারের মুক্তির দাবিতে সাধুগুরুভক্ত ও ওলি-আওলিয়া আশেকান পরিষদের আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার।
এ সময় তিনি বলেন, ‘ব্যক্তির মর্যাদা ও মতপ্রকাশের অধিকার ৫ আগস্টের পর থেকে হরণের শিকার। সেকুলার ফ্যাসিবাদ যেমন দেখেছি, তেমনই এখন ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ মাথা তুলেছে। আমাকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘হাসিনার আমলে সূফি-তরিকতপন্থীরা নির্যাতিত ছিল। ভেবেছিলাম ইউনুসের আমলে পরিবর্তন আসবে—কিন্তু উল্টোটা দেখছি। যারা মাজার ভাঙে তারা ইসলামের শত্রু, এরা ভূরাজনৈতিক সংকট তৈরি করছে; এর প্রভাব ভারতে মুসলমানদের ওপরও পড়ে।’
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আবুল সরকারের পালাগান ছিল নাট্যশৈলীপূর্ণ অভিনয়। এই ন্যূনতম জ্ঞান না থাকায় তাকে ধর্ম অবমাননায় অভিযুক্ত করা মূর্খতা। আমাদের বৃহত্তর ঐক্য গঠন করতে হবে এবং জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে একত্রিত হতে হবে।’
সমাবেশ শেষে তিনি ঘোষণা করেন, ‘সাধুগুরুভক্ত ও ওলি-আওলিয়া আশেকান পরিষদের ব্যানারে সারাদিনব্যাপী ভাবগানের আয়োজন ও মানিকগঞ্জে মহাসম্মেলন করা হবে।’
পুলিশ মামলা নেয়নি অভিযোগ করে আবুল সরকারের সহধর্মিণী পালাকার আলেয়া বেগম বলেন, ‘বাউল-ফকিরদের ওপর হামলার মামলা নিতে পুলিশ গড়িমসি করছে। আমরা তো দেশেরই সংস্কৃতি—তাহলে আমাদের স্থান কোথায়?’ ভাবগানের শিল্পী কোহিনুর আক্তার গোলাপী বলেন, ‘এই বাংলাদেশ সূফীর দেশ। মাজার ভাঙা হচ্ছে, কিন্তু কোনো সংস্কার হচ্ছে না—এটি সাংস্কৃতিক অধিকারের লঙ্ঘন।’
ব্রিটিশ আমলের আইন আজও মানুষকে দমনে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা আকরাম খান। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে আক্রান্ত করছে। বাউল-ফকিররা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত লড়াই করেছেন—এ অত্যাচার তাঁরা মানবেন না। মত প্রকাশের অধিকারকে অপরাধ বানানো যায় না।’
মানবাধিকারকর্মী মুনতাসির রহমান বলেন, ‘নিজ ধর্মবিশ্বাস পালন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান-সংরক্ষিত অধিকার। আবুল সরকারের গ্রেপ্তার এই সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন। ধর্ম অবমাননা—এমন অস্পষ্ট আইনে কাউকে গ্রেপ্তার করা অগ্রহণযোগ্য।’
বাউলদের ওপর হামলা ও পালাগানের অপব্যাখ্যার অভিযোগ দিয়ে ‘শরৎ উদযাপন কমিটি’র সদস্য দীপঙ্কর রায়হান বলেন, 'বাউলদের ওপর নিষ্ঠুর হামলা ন্যক্কারজনক। পালাগানের নাট্যরীতি না বুঝে এর খণ্ডাংশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে।’
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কবি ও ভাববৈঠকীর প্রধান সমন্বয়ক মোহাম্মদ রোমেল। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে আমরা এখনো সেই নৈরাজ্যের মধ্যেই আছি। তৌহিদী জনতা ধর্মের নামে ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে চায়—এরা হাসিনারই ভূত। রাজনৈতিক দলগুলো ভোট হারানোর ভয়ে দায়িত্বশীল আচরণ করছে না।’
সমাবেশে আরো উপস্থিত ছিলেন, লেখক অস্ট্রিক আর্যু, কবি ও চলচ্চিত্র শিক্ষক সাকিরা পারভীন, চলচ্চিত্র নির্মাতা মঞ্জুরুল হক, রাজনীতিকর্মী আব্দুল মজিদ অন্তর, সুফিবাদ সার্বজনীন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান তৌহিদুল ইসলাম চিশতি নিজামী, বিশ্ব সূফী ঐক্য পরিষদের মহাসচিব মো. বেলাল নূরী, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি যুগ্ম মহাসচিব মো. ইব্রাহিম মিঞা ও লেখক আরিফ রহমান প্রমুখ।
অনুষ্ঠান শেষে স্মারকলিপি প্রদান করার জন্য ‘সাধুগুরুভক্ত ও ওলি-আওলিয়া আশেকান পরিষদে’র পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান পাঁচজন। তারা হলেন---ফরহাদ মজহার, মোহাম্মদ রোমেল, আবুল কাশেম, আলেয়া বেগম ও কোহিনুর আক্তার গোলাপী।