বলিউডের ইতিহাসে দিলীপ কুমার আর ধর্মেন্দ্র, দুজনই নিজ নিজ সময়ে ভক্তদের হৃদয় দখল করে রাখা নাম। আত্মজীবনী দিলীপ কুমার: দ্য সাবস্ট্যান্স অ্যান্ড দ্য শ্যাডো বইয়ের অংশ হিসেবে ট্র্যাজেডি কিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মৃতিচারণ লিখেছিলেন ধর্মেন্দ্র।
সালটা ১৯৫২। পাঞ্জাবের লুধিয়ানার ছোট্ট শহর থেকে দ্বিতীয় বর্ষের কলেজ ছাত্র ধর্মেন্দ্র যাচ্ছেন বোম্বে। অভিনয়ে ক্যারিয়ার গড়ার বিষয়ে তখনও কোনো নিশ্চিত পরিকল্পনা নেই। কিন্তু মনের ভেতর বসে গেছে এক নাম দিলীপ কুমার। তার অভিনয়, বিশেষ করে ‘শহীদ’ ছবিতে অনুভূতির যে তীব্রতা ধর্মেন্দ্রকে নাড়া দিয়েছিল, তা থেকে জন্ম নেয় এক অদ্ভুত টান। এই টান থেকেই ধর্মেন্দ্রর মনে হয়, দিলীপ কুমার যেন তাঁরই আপনজন, যেন আপন ভাই।
সেই আবেগ তাকে টেনে নেয় বোম্বেতে। শহরে পৌঁছানোর পর খুব পরিকল্পিত কিছু করেননি তিনি। সরাসরি চলে যান বান্দ্রার পালি মালা এলাকায়, দিলীপ কুমারের বাড়িতে। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, তখন সেই বাড়ির গেটে কোনো প্রহরী ছিল না, কেউ তাঁকে আটকায়ওনি। একেবারে মূল দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে যান তিনি। সোজা উঠোন পেরিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়েন ওপরে, গিয়ে দাঁড়ান এক কক্ষের দরজার সামনে।
ওই ঘরেই ঘুমোচ্ছিলেন এক ফর্সা, পাতলা গড়নের, সুদর্শন যুবক। হঠাৎ কারও উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি উঠে বসেন, আর সেই মুহূর্তে ধর্মেন্দ্র বুঝতে পারেন, তিনি সত্যিই তাকিয়েই আছেন নিজের প্রিয় নায়ক দিলীপ কুমারের দিকে। এমন এক ব্যক্তিগত জায়গায়, একেবারে অজান্তে ঢুকে পড়ার অপরাধবোধ আর ভয়ের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। দিলীপ কুমার উচ্চস্বরে বাড়ির ভৃত্যকে ডাকতেই হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এসে দৌড়ে নীচে নেমে যান ধর্মেন্দ্র, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে সোজা এক ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে বসেন।
সেখানে বসেই তার মাথায় ঢোকে নিজের ভুলের কথা। পাঞ্জাবের গ্রামীণ জীবনে যেমন খোলা দরজা, খোলা উঠান, সবাই সবার ঘরে অবাধে ঢুকতে পারে, কোনো প্রথাগত আনুষ্ঠানিকতা নেই, ধর্মেন্দ্র সেই মানসিকতা নিয়েই বোম্বে এসে ভেবেছিলেন, প্রিয় নায়কের বাসাতেও তেমন করে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু বুঝতে পারেন, তিনি এক বড় শহরে, আর যার বাড়িতে দৌড়ে ঢুকে পড়েছেন, তিনি সারা দেশের তারকা। ভক্তির টানে অপ্রস্তুত আচরণ, কিন্তু তবু সেই প্রথম সাক্ষাৎ থেকে তাঁর মনে গেঁথে যায় যে, অতি আবেগও কখনও কখনও অসাবধানতা তৈরি করে।
এর ছয় বছর পর, অর্থাৎ প্রায় ১৯৫৮ সালের দিকে আবারও বোম্বেতে ফিরলেন ধর্মেন্দ্র, তবে এবার উদ্দেশ্য একেবারে পরিষ্কার। তিনি অংশ নিলেন ইউনাইটেড প্রডিউসার্স আর ফিল্মফেয়ার ট্যালেন্ট কনটেস্টে। সিনেমায় অভিনয় করার ইচ্ছা এবার আর কল্পনা নয়, বাস্তব পরিকল্পনা। অনেক বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত বাবাকে রাজি করিয়ে তিনি এই প্রতিযোগিতায় নাম লেখালেন। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার পর ফিল্মফেয়ার অফিসে এক ফটোশুটের ডাক পান তিনি। তখনও তিনি মেকআপ করতে জানেন না, তবে তাঁর স্বাভাবিক চেহারায় মুগ্ধ হন আলোকচিত্রী, শুধু একটু টাচ আপের জন্য ডাকেন একজন মেকআপ আর্টিস্টকে।
সেই মেকআপ আর্টিস্ট ছিলেন এক তরুণী, নাম ফারিদা। ফিল্মফেয়ারের তৎকালীন সম্পাদক এল. পি. রাও শান্ত গলায় ধর্মেন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি জানেন, মেয়েটি কে? না বলার পর জানলেন, এ যে দিলীপ কুমারেরই বোন, আর সে সময় ফেমিনা পত্রিকায় কাজ করছেন। সেই মুহূর্তে ধর্মেন্দ্রর মাথায় আবারও ফিরে আসে তার পুরোনো টান। তিনি ফারিদার কাছে অনুরোধ করেন, যেন তাকে একবার দিলীপ কুমারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দেন। বলেন, তিনি মনে থেকে বিশ্বাস করেন, দিলীপ সাহেব তাঁর বড় ভাই। ফারিদা একটু মজা পেলেও কথা দেন, যদি ভাই রাজি থাকেন, তবে ফিল্মফেয়ার অফিসে খবর পাঠাবেন।
পরের দিনই ফোন আসে। ঠিক হয়, সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় তিনি যাবেন পালি হিলের ঠিকানা ৪৮ নম্বর বাংলোয়। সেই রাতের অভিজ্ঞতা ধর্মেন্দ্র পরে বহুবার স্মরণ করেছেন। বাংলোর লনে বসে দিলীপ কুমার তাকে পাশে বসার জায়গা করে দেন। কথা বলেন একেবারে বড় ভাইয়ের মতো। তিনি ইংরেজি, পাঞ্জাবি আর উর্দু মিলিয়ে কথা বলেন, আর ধর্মেন্দ্র যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকেন।
এমকে/এসএন