বলিউডে প্রেমের গল্প অনেক। কিন্তু ধর্মেন্দ্র আর ড্রিম গার্ল হেমা মালিনীর প্রেমকাহিনি আলাদা। একদিকে নাটকীয়তা, অন্যদিকে অসম্ভব মিষ্টি–রোম্যান্স। আর এই প্রেমের জন্য নাকি লাগত হাজার হাজার রিটেক! পর্দায় যখন তাদের জুটি জমতে শুরু করলো, তখন ধর্মেন্দ্র ইতোমধ্যেই বড় তারকা। আর হেমা মালিনী তখন বলিউডের নতুন সেনসেশন, সবার প্রিয় ‘ড্রিম গার্ল’।
১৯৭০-এর মধ্যে ‘শরাফত’, ‘তুম হাসিন ম্যায় জওয়ান’, ‘নয়া জামানা’—একের পর এক হিট। ঠিক এই সময়েই জন্ম নেয় এক ‘হট রিল পেয়ার’, যা খুব দ্রুতই হয়ে যায় রিয়েল লাইফ জুটি। প্রথম দেখাতেই নাকি ধর্মেন্দ্র হেমার প্রেমে পড়েছিলেন। হেমা মালিনী জানতেন, ধর্মেন্দ্র বিবাহিত। তাই প্রথমে তিনি দূরত্ব রেখেই পছন্দ করতেন, কিন্তু প্রেমে জড়াতে চাননি। তবু ধর্মেন্দ্রর নরম স্বভাব, স্নেহশীল ব্যবহার আর যত্ন ধীরে ধীরে গলিয়ে দেয় হেমাকে।
হেমা পরে বলেছেন, তিনি স্বামী হিসেবে ধর্মেন্দ্র–ধরনের একজনকেই চাইতেন। শুধু শর্ত ছিল, তিনি যেন অবিবাহিত হন। নিজের ভালোবাসা সম্পর্কে হেমার মন্তব্য ছিল, এটা কোনো হিসেবি সিদ্ধান্ত না। তার ভাষায়, ‘এটা ছিল নিয়তি।’ শোনা যায়, তাদের প্রথম দেখা আরও আগে। খাজা আহমেদ আব্বাসের ‘আসমান মহল’ ছবির প্রিমিয়ারে। সেখানে হেমাকে দেখে ধর্মেন্দ্র আর শশী কাপুর পাঞ্জাবিতে বলেছিলেন, ‘কুড়ি ভড্ডি চাঙ্গি হ্যায়’—মানে, মেয়েটা দেখতে দারুণ তো!
প্রেম যখন জমে উঠলো, তখন সেটে শুরু হলো ধর্মেন্দ্রর সেই বিখ্যাত খেয়ালিপনা। ১৯৭৫-এর দিকে, একসঙ্গে অসংখ্য সুপারহিট ছবির শুটিং চলাকালীন, হেমার প্রতি সম্পূর্ণ মুগ্ধ ছিলেন তিনি। হেমার সঙ্গে দৃশ্য থাকলেই তিনি বারবার রিটেক চাইতেন। সোজাসাপটা কারণ হলো, পছন্দের মানুষটার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটানো। এই কাজের জন্য ধর্মেন্দ্র গোপন কোড বানিয়ে নিলেন লাইট বয়দের সঙ্গে।
শুটিং সেটে যদি তিনি নাকে হাত দিতেন, তার মানে—আরও একটি রিটেক দরকার। আর যদি কান টেনে ধরতেন, তার মানে—শট ওকে, রিটেকের দরকার নেই। লাইট বয়েরাও প্রেমের এই লীলা থেকে নিজেদের আলাদা রাখেননি। ট্রলি একটু কাঁপিয়ে, রিফ্লেক্টর সামান্য এদিক–ওদিক করে তারা ইচ্ছে করেই শট নষ্ট করতেন। আর তার বিনিময়ে পেতেন ‘‘রাজকীয়” একশ টাকা করে টিপ। ভালো দিনের শুটিংয়ে শুধু এই রিটেকের টাকাতেই নাকি তাদের আয় হতো কয়েক হাজার! প্রিয়তমা সেটে থাকলে ধর্মেন্দ্র নাকি শট শেষ হয়ে গেলেও আড্ডার অজুহাত খুঁজতেন। এমনও সময় গেছে, যখন তার কাজ নেই, তবু তিনি সেট ছেড়ে যেতে চাইতেন না।
কিন্তু পর্দার এই রোম্যান্টিক গল্পের বাইরে, বাস্তবে ছিল বড়সড় বাধা। হেমা মালিনীর পরিবার ধর্মেন্দ্র–হেমা সম্পর্কের প্রবল বিরোধিতা করছিল। পরিবার থেকে তার বিয়ের জন্য পাত্র ঠিক হলো অন্যজন—নায়ক জিতেন্দ্র। খবর বেরিয়ে এল, জিতেন্দ্র আর হেমার বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। পরিবার থেকে চাপ বাড়তেই হেমা বাবা–মাকে বলেছিলেন, “আপনারা অন্য কাউকে খুঁজে নিন।” যদিও পরে তিনি স্বীকার করেছেন, যাকেই আনতেন, সম্ভবত তিনিই ফিরিয়ে দিতেন। কিন্তু এই খবর শুনে চুপ করে থাকলেন না ‘হি-ম্যান’। জিতেন্দ্র যখন মুরব্বিদের আশীর্বাদ নিয়ে হেমাকে বিয়ে করতে চেন্নাই যাচ্ছেন, তখন ধর্মেন্দ্রও ছুটলেন সেখানে, সেই বিয়ে থামাতে। শেষ পর্যন্ত ধর্মেন্দ্রর দৃঢ়তা আর হেমার নিজের সিদ্ধান্ত মিলেই বদলে দিল সবকিছু। একদিন হেমা নিজে তাকে ডেকে সরাসরি বললেন, “এখনই আমাকে বিয়ে করো।”
তাদের বিয়ে সেই সময়ের বলিউডের সবচেয়ে গোপন খবরগুলোর একটি ছিল। অনেক দিন পর্যন্ত কারও জানা ছিল না, হেমা আর ধর্মেন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেছেন। পরে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে—নাকি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তারা বিয়ে করেছেন। ধর্মেন্দ্র আর হেমা মালিনী এই অভিযোগ সবসময় অস্বীকার করেছেন। তাদের দাবি, এই সব গল্প আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বানানো মিথ। তাদের আসল বিয়ে হয়েছে ইয়েঙ্গার রীতিতে, পূর্ণ হিন্দু আচার মেনে। এই গোপন বিয়ের খবর সামনে আনেন সাংবাদিক ভারতী এস. প্রধান। সেটাও আসে একদম কাকতালীয়ভাবে। তার এক সহকর্মী, যিনি নিজেও ইয়েঙ্গার, বাড়িতে পরিচিত পুরোহিতকে পেয়েছিলেন।
আলাপের এক ফাঁকে পুরোহিত বলে ফেলেন, সপ্তাহখানেক আগেই তিনি ধর্মেন্দ্র–হেমার বিয়ে পড়িয়েছেন। এখান থেকেই শুরু হয় খবরের সূত্র। সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর যেন ছোটখাটো ভূমিকম্প নামে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। হেমার মা সংবাদটি নিশ্চিত করলেও একরকম অভিমানে বলেছিলেন, ধর্মেন্দ্রর বয়স নাকি তার মেয়ের চেয়ে তার নিজের বয়সের কাছাকাছি। প্রথম দিকে হেমা এ নিয়ে বিরক্ত হয়েছিলেন।
আর ধর্মেন্দ্র? সাংবাদিক ভারতী প্রধানের এই খবর বের করে আনার কৌশল দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। তার প্রতিক্রিয়া ছিল, “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, তুমি সত্যিই মাদ্রাজ গিয়েছিলে।” পরে অভিনেতা ঋষি কাপুরও মজার ভঙ্গিতে বলেছেন তাঁদের বিয়ের কথা। একবার হোটেলে তিনি হঠাৎ দেখেন, ধর্মেন্দ্র আর হেমা একসঙ্গে। তখন নীতু সিংকে সদ্য বিয়ে করেছেন ঋষি, আর নীতু তখন অন্তঃসত্ত্বা। নীতুকে দেখে ধর্মেন্দ্র হেমাকে এমনভাবে ইঙ্গিত করেছিলেন, যেন বলতে চাইছেন—“এখন থেকে আমাদেরও এই পরিস্থিতি হবে।” এরপর তারা একসঙ্গে ডান্স ফ্লোরে যান। আর সেখানেই হেসে–খেলে স্বীকার করেন, তারা সত্যিই বিয়ে করে ফেলেছেন।
এভাবেই পাঞ্জাবের ‘হি-ম্যান’ নিজের প্রেম জেতার জন্য বানালেন কোড ল্যাঙ্গুয়েজ। থামিয়ে দিলেন অন্য এক বিয়ের আয়োজন। আর গোপনে ইয়েঙ্গার রীতিতে বিয়ে করে তৈরি করলেন হিন্দি সিনেমার অন্যতম বিখ্যাত প্রেমের গল্প। একটি প্রেম কাহিনি, যা আজও শোনা হয় হাসিমুখে, আর মনে পড়ে একটাই কথা—পর্দার রোম্যান্স অনেক সময় বাস্তবকেও হার মানিয়ে দেয়।
এসএন