শুধু আওয়ামী লীগ করার কারণে যেন বিচার না হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এমন আর্জি জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফসহ চারজনের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।
মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) জুলাই গণঅভ্যুত্থানে কুষ্টিয়ায় ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য শেষে এই আর্জি জানান তিনি। ট্রাইব্যুনাল-২ এর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেলে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম।
এদিন বেলা ১১টা ৫ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হয়। প্রথমেই হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রসিকিউশন। এতে এ মামলার বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। একইসঙ্গে এ অপরাধের দায়মুক্তির সুযোগ নেই বলেও উল্লেখ করেন।
এ মামলায় চার আসামিই পলাতক রয়েছেন। তবে আসামির অনুপস্থিতিতে বিচারের বিধান আওয়ামী লীগ সরকারই তৈরি করেছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। তার এমন কথায় আইনটি স্মরণ করেন ট্রাইব্যুনাল। সবশেষ এই বিচারপ্রক্রিয়া কোনো রাজনৈতিক বিরোধিতা নিষ্পত্তির জন্য নয় জানিয়ে উল্লেখ করে প্রসিকিউশন। কেননা জুলাই-আগস্টে নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালিয়ে কুষ্টিয়ায় ছয়জনকে হত্যা করেন হানিফরা। যার অকাট্য সাক্ষ্য রয়েছে বলেও জানান এই প্রসিকিউটর।
প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে কিছু কথা বলার জন্য ট্রাইব্যুনালের অনুমতি চান এ মামলায় আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। তিনি বলেন, আমি প্রসিকিউশনের বক্তব্যের কিছু অংশের সঙ্গে একমত। তবে আমরা (আসামিরা) আওয়ামী লীগ করি। তাই শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ করার কারণে যেন বিচার না হয়।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, আল্লাহকে হাজির-নাজির রেখে আমরা এখানে ন্যায়বিচার করতে বসেছি। কোনো নির্দোষ মানুষ যেন বিচারের মুখোমুখি না হন। অভিযুক্তরাও বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন। অতএব আপনার শঙ্কা রাখার কারণ নেই।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় মোট সাক্ষী ৩৮ জন। এর মধ্যে শহীদ পরিবারের ৮, প্রত্যক্ষদর্শী ৮, আহত ৮, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ৬, পুলিশ ১, সাংবাদিক ১, জব্দতালিকা ২, বিশেষজ্ঞ ২, বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ১ ও মূল তদন্ত কর্মকর্তা ১ জন রয়েছেন। এদিন প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণে কথা থাকলেও প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ৮ ডিসেম্বর নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল।
হানিফ ছাড়া বাকি তিন আসামি হলেন- কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সদর উদ্দিন খান, জেলা সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা।
বিচার শুরুর আদেশের দিন চারজনের বিরুদ্ধে আনা তিনটি অভিযোগ পড়া হয়। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর আবদুস সোবহান তরফদার, আবদুস সাত্তার পালোয়ান।
এর আগে, ২৮ অক্টোবর হানিফসহ পলাতক চার আসামির পক্ষে অভিযোগ পড়েন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। শুরুতেই তিনি ফরমাল চার্জে প্রসিকিউশনের আনা পটভূমি নিয়ে সমালোচনা করেন। এরপর সুনির্দিষ্ট তিনটি অভিযোগ পড়ে আসামিদের অব্যাহতির আবেদন করেন। এর আগের দিন ২৭ অক্টোবর এ নিয়ে শুনানি শেষ করে প্রসিকিউশন।
গত ২৩ অক্টোবর হানিফসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার কথা ছিল। তবে পলাতক থাকায় আইনানুযায়ী তাদের পক্ষে স্টেট ডিফেন্স নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। ১৪ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে এই চারজনকে হাজির হওয়ার নির্দেশ ছিল। না আসায় তাদের গ্রেপ্তারে জাতীয় দৈনিক দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আদেশ দেওয়া হয়। ৬ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ৫ অক্টোবর তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দেন প্রসিকিউশন। এতে সুনির্দিষ্ট তিনটি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে উসকানিমূলক বক্তব্য, ষড়যন্ত্র ও কুষ্টিয়ায় ছয়জনকে হত্যা।
উল্লেখ্য, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো হয়। তাদের গুলিতে শহীদ হন শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম, সুরুজ আলী বাবু, শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মুস্তাকিন, উসামা, ব্যবসায়ী বাবলু ফরাজী ও চাকরিজীবী ইউসুফ শেখ। আহত হন বহু নিরীহ মানুষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই চারজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়। পরে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা।
এবি/টিকে