ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ পদ্ধতি

দেশে সাম্প্রতিক সময়ে খাঁচায় মাছ চাষ নতুন আঙ্গিকে শুরু হলেও বিশ্বে এর ইতিহাস অনেক পুরনো। চীনের ইয়াংঝি নদীতে আনুমানিক ৭৫০ বছর আগে এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু হয়। আমাদের দেশে বাণিজ্যিকভাবে খাঁচায় মাছ চাষ শুরু হয় চাঁদপুরে ডাকাতিয়া নদীতে।

এই পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য একটি খাঁচা তৈরিতে খরচ হয় মাত্র ১৫ হাজার টাকা। পরে পোনা ভরে খাঁচা নদীতে ভাসিয়ে রাখা হয়। প্রতি খাঁচায় পোনা ছাড়া যায় ৭০ হাজার। মাছের পোনা ও খাবার কিনতে খরচ হয় ১৮ হাজার টাকা। ছয় মাস পর এই মাছ বিক্রি করা হয়।

ভাসমান পদ্ধতিতে নদীতে খাঁচায় মাছ চাষে খরচ বাদ দিয়ে লাভ থাকে অন্তত ৩০ হাজার টাকা। ফলে সম্প্রতি পাবনার বিভিন্ন নদ-নদীতে এই পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে স্বাবলম্বী হচ্ছেন স্থানীয় বেকার যুবকেরা।

খাঁচায় মাছ চাষের সুবিধা

  • ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ করলে পুকুরের ন্যায় জলাশয়ের প্রয়োজন হয় না।
  • প্রবহমান নদীর পানিকে যথাযথ ব্যবহার করে মাছ উৎপাদন বাড়ানো যায়।
  • মাছের বর্জ্য প্রবহমান পানির সাথে অপসারিত হয় বিধায় পানিকে দূষিত করতে পারে না।
  • মাছের উচ্ছিষ্ট খাদ্য খেয়ে নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজাতির প্রাচুর্য বৃদ্ধি পায়।
  • প্রবহমান থাকায় প্রতিনিয়ত খাঁচার অভ্যন্তরের পানি পরিবর্তন হতে থাকে, ফলে পুকুরের চেয়ে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করা যায়।

খাঁচা স্থাপনের উপযোগী স্থান

  • খাঁচা স্থাপনের জন্য নদীর এমন অংশ নির্বাচন করতে হবে যেখানে একমুখী প্রবাহ কিংবা জোয়ার ভাটার শান্ত প্রবাহ বিদ্যমান। নদীর মূল প্রবাহ, তথা যেখানে অত্যধিক তীব্র স্রোত বিদ্যমান সেখানে খাঁচা স্থাপন না করায় ভালো। নদীতে প্রতি সেকেন্ডে ৪-৮ ইঞ্চি মাত্রার পানি প্রবাহে খাঁচা স্থাপন মাছের জন্য উপযোগী, তবে প্রবাহের এ মাত্রা সর্বোচ্চ সেকেন্ডে ১৬ ইঞ্চি এর বেশী না হওয়া উচিত।
  • মূল খাঁচা পানিতে ঝুলন্ত রাখার জন্য নূন্যতম ১০ ফুট গভীরতা থাকা প্রয়োজন। যদিও প্রবহমান পানিতে তলদেশে বর্জ্য জমে গ্যাস দ্বারা খাঁচার মাছের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম; তথাপি খাঁচার তলদেশ নীচের কাদা থেকে নূন্যতম ৩ ফুট ব্যবধান থাকা আবশ্যক।
  • স্থানটি লোকালয়ের কাছে হতে হবে, যাতে সহজে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
  • খাঁচা স্থাপনের কারণে যাতে কোনোভাবেই নৌ-চলাচলে বিঘ্ন না ঘটে এমন স্থান হতে হবে।

সর্বোপরি, খাঁচা স্থাপনের জায়গাটি এমন হতে হবে, যাতে শিল্প বা কলকারখানার বর্জ্য কিংবা পয়ঃনিষ্কাশন পানি অথবা কৃষিজমি থেকে বন্যা বা বৃষ্টি বিধৌত কীটনাশক প্রভাবিত পানি নদীতে পতিত হয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে খাঁচার মাছ মারা যেতে না পারে।

ভাসমান খাঁচা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ

  • খাঁচা তৈরির মূল পলিইথিলিন জাল (৩/৪ ইঞ্চি থেকে ১ ইঞ্চি মেসের)।
  • রাসেল নেট (খাদ্য আটকানোর বেড়া তৈরিতে কাজে লাগবে)।
  • নাইলনের দড়ি ও কাছি।
  • কভার নেট বা ঢাকনা জাল (পাখির উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্য)।
  • ১ ইঞ্চি জিআই পাইপ (৭০ ফুট প্রতিটি খাঁচার জন্য)।
  • ফ্রেম ভাসমান রাখার জন্য শূন্য ব্যারেল/ড্রাম (২০০ লিটারের পিভিসি ড্রাম, ওজন ৯ কেজি’র ঊর্ধ্বে)।
  • খাঁচা স্থির রাখার জন্য গেরাপি (অ্যাঙ্কর)।
  • ফ্রেমের সঙ্গে বাঁধার জন্য মাঝারী আকারের সোজা বাঁশ (প্রয়োজনীয় সংখ্যক)।

খাঁচার আকার
খাঁচায় মাছ চাষের জন্য সাধারণত দুই আকারের জাল তৈরি করা হয়, যেমন- ২০ ফুটx ১০ ফুটx ৬ ফুট এবং ১০ ফুটx ১০ ফুটx ৬ ফুট। জালগুলো মেস ৩/৪ ইঞ্চি থেকে ১১/৪ ইঞ্চির মধ্যে হওয়া ভালো। এতে সহজে পানি খাঁচার ভিতরে সঞ্চালিত হতে পারে।

ফ্রেম তৈরি ও স্থাপন
খাঁচাগুলোর ফ্রেম তৈরি করতে প্রথমে ১ ইঞ্চি জিআই পাইপ দ্বারা আয়তকার ২০ ফুটx ১০ ফুট ফ্রেম তৈরি করা হয়। আর মাঝে ১০ ফুট আরেকটি পাইপ বসিয়ে ঝালাই করে ফ্রেম তৈরি করা হয়। এতে একটি ফ্রেমে সরাসরি ২০ ফুটx ১০ ফুট আকারের খাঁচা বসানো যায় আবার প্রয়োজনবোধে ১০ ফুটx ১০ ফুট আকারের দু’টি খাঁচাও বসানো যায়। প্রতি দুই ফ্রেমের মাঝে ৩টি ড্রাম স্থাপন করে সারিবদ্ধভাবে ফ্রেমগুলো স্থাপন করতে হবে।

খাঁচায় সম্পূরক খাদ্য প্রদান
খাঁচায় মাছ চাষের জন্য প্রবহমান পানিতে ভাসমান খাদ্যের বিকল্প নেই। এছাড়াও বর্তমানে বেসরকারি উদ্যোগে বহু খাদ্য কারখানা স্থাপিত হয়েছে। যেখানে পিলেট আকারের পানিতে ভাসমান সম্পূরক খাদ্য তৈরি করে থাকে। মাছ খাঁচায় মজুদের পর হতে বাজারজাত করার পূর্ব পর্যন্ত দৈহিক ওজনের বিবেচনায় খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা ৮ শতাংশ হতে ৩ শতাংশ এর মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। মাছের ওজন ৩০০-৫০০ গ্রাম হওয়া পর্যন্ত সম্পূরক খাদ্য প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে।

কারখানায় তৈরি ভাসমান খাবার ব্যবহার করে দেখা গেছে যে, মজুদ থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত ৭৫০-১০০০ গ্রাম ওজনের মাছ উৎপাদন করতে সর্বোচ্চ ১.৫ কেজি খাদ্যের প্রয়োজন হয়।

 

টাইমস/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

‘আমরা বিএনপি নই, জামায়াতও নই, আমরা নতুন বাংলাদেশের পথে’ Nov 02, 2025
img
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেই জুলাই সনদের আদেশ জারি করতে হবে : হাসনাত Nov 02, 2025
img
চলতি সপ্তাহেই নতুন দল নিবন্ধনের গণবিজ্ঞপ্তি: ইসি সচিব Nov 02, 2025
img
অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে উড়িয়ে দিল ভারত Nov 02, 2025
img
তখনকার আমাকে দেখে ভীষণ আফসোস হয় : মুনমুন Nov 02, 2025
img
বাঙালি দর্শকের সিনেমা রুচির বিবর্তন: সুব্রত গুহ রায় Nov 02, 2025
img
গান বন্ধের সঠিক সময় নিয়ে পরামর্শ দিলেন কৌশিক গাঙ্গুলি Nov 02, 2025
img
চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ ১৮ নভেম্বর : ইসি সচিব Nov 02, 2025
img
ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির আহ্বান জানাল প্রধান উপদেষ্টা Nov 02, 2025
img

আইসিসি নারী বিশ্বকাপ

নারী বিশ্বকাপের ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টসে হেরে ব্যাটিংয়ে ভারত Nov 02, 2025
img
উপহারের সেই নৌকা জমা দিলেন জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির Nov 02, 2025
img
এমবাপের জোড়া গোল, ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে দাপুটে জয় রিয়ালের Nov 02, 2025
img
ইন্ডাস্ট্রি আমাকে ইউজ করেনি, করতেই পারত : ইন্দ্রানী দত্ত Nov 02, 2025
img
নিজের মূল্যবোধে অটল অভিনেত্রী ইশা সাহা Nov 02, 2025
img
জন্মদিনে কিং খানকে শুভেচ্ছা বার্তা মমতা ব্যানার্জির Nov 02, 2025
img
সমাজে অভিনেত্রীর ভুল ধারণা বদলাতে হবে : ঋতাভরী চক্রবর্তী Nov 02, 2025
img
স্বাধীনতা-গণতন্ত্র ও দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত ছাত্রদল : এ্যানি Nov 02, 2025
img
নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালে বৃষ্টির হানা, আছে রিজার্ভ ডে Nov 02, 2025
img
মায়ের শিক্ষা থেকে গড়ে উঠেছে মিমি দত্তের দৃঢ় মনোভাব Nov 02, 2025
img
প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা কলি’ নিতে সম্মত এনসিপি, জানালেন পাটওয়ারী Nov 02, 2025