আত্মহত্যার রাস্তা ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হওয়ার গল্প!

খুব দ্বিধায় আছি, লিখবো কি-না? কারণ, এ ঘটনার সাথে পরিবার জড়িয়ে আছে। হয়তো লেখার পর ফোনও আসবে; কেন এমন জিনিস পাবলিক পরিসরে শেয়ার করলাম। কিন্তু আমি লিখছি তাদের জন্য; যারা আত্মহত্যা করতে চলেছেন বা করতে চান।

‘আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম আব্বু-আম্মুর বনিবনা হয় না। যার প্রভাব আমার পুরো জীবনে পড়েছে। আব্বুর রাগ বেশি, আম্মুর সাথে সমস্যা বা আরো নানা ধরনের ইহজাগতিক কারণে আমার প্রতি যে দায়িত্ব পালন করার কথা; তিনি তা করেননি। ১৯৯৯ থেকে ওনাকে কখনো এক সপ্তাহ কাছে পেয়েছি কি-না নিশ্চিত করে বলতে পারব না। যখনই পেয়েছি; সময়টা কেবল পারিবারিক জটিলতায় কেটেছে। পরিবারের আর্থিক অসঙ্গতি, আব্বুর চাপিয়ে দেয়া ঋণের বোঝা; আম্মুর দুঃখ, একা আমাকে বড় করার ও টিকে থাকার সংগ্রাম— সব আমাকে প্রতিটা দিন গ্রাস করেছে, এখনো করে।’

‘‘নিঃসঙ্গতা, চরম একাকিত্ববোধ থেকে আত্মহত্যার চিন্তা আসে৷ এ সময় নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার বদলে চারিদিকে তাকালে কাউকে না কাউকে ঠিকই পাওয়া যায়।’’

আব্বুর ভালোবাসা পেতে এইচএসসিতে ঢাকায় ভর্তি হলাম। আব্বু তাতে আরো নারাজ হলেন, আমার ঠাঁই মিললো হোস্টেলে। জ্যাঠামণি কলেজে ভর্তি করালেন, প্রবাসী ফুপিরা মাসের খরচ পাঠাতেন, এই দিয়ে চলতাম। যেহেতু তার কাঁধে উঠে পড়েছি, তাই বাবাও মাঝেমধ্যে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে যেতেন। আমাকে দেখতে আসতেন ২ মিনিটের জন্য। আমি তাও ভাবতাম, বছরে একবার দেখার চেয়ে এও ভালো অন্তত মাসে একবার-দুইবার আব্বুকে দেখতে পাই।

ঢাকায় প্রাইভেট পড়া বেশ ব্যয়বহুল, তাই কোন মাসে এক সাবজেক্ট পড়তাম, পরের মাসে অন্য সাবজেক্ট। হোস্টেলের পরিবেশের কথা বলাই বাহুল্য। এমন কষ্ট করেও এইচএসসিতে পেলাম ৪.৬। এসএসসিতে গোল্ডেন, ছোটবেলায় অধিকাংশ বৃত্তি পেয়ে আসা আমার পক্ষে এই ফল মেনে নেয়া কষ্টের ছিল। তারমধ্যে আমার কাছের বন্ধুরা সব ৫ পেয়েছে। এর আগে ভর্তি হলাম মেডিকেল কোচিংয়ে, কিন্তু রেজাল্টে আমার মন ভেঙে গেল।

তবুও মিরাকলের আশায় সব জায়গায় পরীক্ষা দিলাম, ভর্তি পরীক্ষার ফরম কেনা বা সেখানে যাওয়াও তো বেশ ব্যয়বহুল। তাই কেবল চট্টগ্রাম, ঢাকা, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর, মেডিকেল ও ডেন্টালের ফরম তোলা। সব জায়গায় একাই পরীক্ষা দিতে গিয়েছি, বাবা-মাকে ছাড়া। চট্টগ্রামে কেবল মেধাতালিকায় ছিলাম। বাকি সব ওয়েটিং। মেডিকেলের ওয়েটিং তো ইতিহাস! সব জায়গায় কেবল সায়েন্সে পরীক্ষা দিয়েছি। কী মনে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডি’ ইউনিটের ফরম তুলেছিলাম। এক সপ্তাহের প্রস্তুতিতে ‘ডি’ তেই কেবল মেধাতালিকায় আসলাম।

আসলে কি হবে? ডাক্তার যে হতেই হবে। আম্মু তার সারাজীবনের সঞ্চয়, ফুপিদের দেয়া টাকা নিয়ে হাজির আমাকে ডেন্টালে ভর্তি করাতে। কারণ সেখানকার ওয়েটিংয়ে শুরুর দিকে আছি, প্রাইভেট ডেন্টালে ভর্তি হতে পারতাম। অনেক আশা-নিরাশার দোলাচালে ভর্তি হলাম। কাছের আত্মীয়রা কানাঘুষা শুরু করেছে যার বাবার টাকা নাই সে কি করে প্রাইভেটে পড়ার স্বপ্ন দেখে? আমিও সে কথা আমলে নিলাম। বই, পড়ার খরচ ও পরীক্ষার ফি এত বেশি যে, এটা দিলে প্রবাসী ফুপিদের ওপর আম্মুর ওপর অযথা চাপ দেয়া হবে।

সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডি’তেই ভর্তি হব। চেয়েছিলাম আইআর (ইন্টান্যাশনাল রিলেশন্স), পেলাম সাংবাদিকতা। আম্মু কয়েকদিন কথা বলেনি, এর মধ্যে ডেন্টালে ভর্তি বাতিল করলাম। আম্মুকে বোঝালাম আমি আবার কোচিং করব। আবার পরীক্ষা দেব। এবার ভার্সিটি+মেডিকেল কোচিং শুরু করলাম। এ সময় বোকামি বা বুদ্ধির কাজ যেটা করলাম তা হলো— গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় ক্লাস শুরু করা, পরীক্ষাও দিতাম। সায়েন্সের শিক্ষার্থীর পক্ষে ইতিহাস, দর্শন পড়া খুব কঠিন। বিভাগের ক্লাসগুলো তাই আমার ভালো লাগতো না। ফার্স্ট ইয়ারের পুরোটা সময় ক্লাসের পেছনে বসে ইউসিসির গাইড পড়তাম, ফলাফল প্রথম সেমিস্টারে মাত্র ৩.২৫।

অবেশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। আবার মেডিকেলে পরীক্ষা, কিন্তু সেই যথারীতি ওয়েটিং। ডেন্টালেও তাই। এদিকে ডিপার্টমেন্টের কোন কিছুই করতে পারছি না। আমার প্রিয় এক শিক্ষকের পরীক্ষা ছিল মেডিকেলে পরীক্ষার দু-একদিন পরেই, বিভিন্ন চিন্তায় ভুলেই গিয়েছি। শেষ হওয়ার বিশ মিনিট আগে হাজির হলাম। শিক্ষক প্রচুর বকা দিলেন, পরীক্ষা নিলেন না, এটাই স্বাভাবিক। আমি অনেক কান্নাকাটি করলাম। লাভ হলো না। সব চাপ একসাথে এলো।

কলেজ জীবনে একটা বিখ্যাত ভুল তো ছিলোই। কলেজের শেষ দিকে এসে আমার দুই এক বন্ধুর প্ররোচনা বা প্রবঞ্চনায় আমি অযাচিত এক সম্পর্কে জড়ালাম; যেটা আমাকে আরো তিলে তিলে ক্ষয় করে দিচ্ছিলো। একটাই ভয় ছিলো বাসায় জানালে কি হবে? সব সময় ভাবতাম আমি অনেক পড়শোনা করেছি, কিন্তু পরিবারে এই জটিল বিষয়ের কথা জানলে আমার পড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এটার চিন্তায় সম্পর্কটিকে প্রথম বর্ষ পর্যন্ত টানলাম।

‘এই জগতে আমাদের ঠাঁই নেই’। সমাজ, ধর্ম, সম্প্রদায় বা রাষ্ট্র তাদের সম্পর্ক মেনে নেবে না। তাই মৃত্যুই একমাত্র পথ। সত্যিই কি বিকল্প পথ নেই?

মেডিকেলে না টিকে বা ভর্তি না হয়ে আম্মুর আশা ধ্বংস করা, বিভাগে পরীক্ষা না দিতে পারা আর ভয় থেকে তৈরি হওয়া সম্পর্ক সব একাকার হলো। ২০১১ সালে সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের শেষ দিকে (সঠিক সময় মনে নেই) কোন এক রাতে একসাথে অনেকগুলো ওষুধ (সঙ্গত কারণে নাম বললাম না) খেয়ে ঘুমিয়ে যাই। সে সময় থাকতাম শামসুননাহারের ৪২৫ নম্বরে। নতুন রুমে উঠেছি বলে রুমমেটদের সাথে তেমন কথা হতো না।

সকালে উঠে ২৬ বার বমি করেছি, বেঁচে আছি দেখে অবাক হলাম। শরীর এত খারাপ লাগছিল বলে পুরনো গণরুমের বন্ধুদের কাছে গেলাম। ব্যাপারটা ওদেরকে বললাম, ওরা আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেল। ডাক্তার বলছিলেন, আমি অনেক লাকি যে মরি নাই। যেই ওষুধ খেয়ে ১৫ ঘন্টা সারভাইভ করেছি, অনেকে নাকি এত সময় বাঁচে না। তিনদিন হসপিটালের ফ্লোরে ছিলাম। বিষয়টা তৃতীয় দিনে আমার এক বান্ধবী বাসায় জানিয়ে দিলো; আমি যেটা চাইনি। ডাক্তাররা মজা করছিল, ডাক্তার হতে না পেরে আমি রোগী হলাম এই বলে।

এক ফোঁটা পানি খেতে পারিনি তিনদিন, স্যালাইন দেয়া থাকত। তিনদিন পর ফেরত আসলাম, আম্মুর কান্নাকাটিতে আব্বু আমাকে হলে দেখতে আসে, হসপিটালে যায়নি। ওই ওষুধ খাওয়ার কারণে আমার লিভারে কিছু ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, ডাক্তাররা তা হতে দেননি। তবে অনেক বছর ভুগতে হয়েছে। ওই সময়ের জন্য হলমেট ফারজানা, ফাহমিদা, জেসি, জিসি, মৌটুশির কাছে আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ। ওরা না হলে আমাকে কে দেখতো! আমার সাবেক অযাচিত বয়ফ্রেন্ডকেও আমি তার সকল কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা করে দিয়েছি। কারণ, ওই সময় সে আমার টেক কেয়ার করেছে। কিন্তু সম্পর্ক আর ধরে রাখিনি। ওই আত্মহত্যার প্রচেষ্টা আমাকে অনেক শক্ত বানিয়েছে, মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখতে কেমন লাগে তা শিখিয়েছে। ডাক্তাররা বলেছিলেন, একবার চেষ্টা করলে নাকি মানুষ বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আমি করিনি। আমি টিকে থাকার অনন্ত সত্যকে খুঁজে পেয়েছি।

সেই মিডটার্ম আমি শিক্ষক উপদেষ্টার সহযোগিতায় দিতে পেরেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে ‘ক’ ও ‘ঘ’ দুটোতেই ফেল করেছি। আমার সেই জটিল সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছি। তিন চার মাস পরে বৈশাখী টেলিভিশনে কাজ শুরু করি। দ্বিতীয় বর্ষ থেকে প্রতিটি ক্লাস করার চেষ্টা করেছি। ভালো ফলাফল করার চেষ্টা করেছি। বাকিটাই বর্তমান। চ্যানেল আই, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবনের কিছু সময় কাটিয়ে এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই।

এরপরও আমার জীবনে আরো অনেক কষ্টের অভিজ্ঞতা এসেছে, কঠিন সময় গিয়েছে। কাছের অনেক মানুষ দূরে চলে গিয়েছে, কর্মস্থলে কঠিন সময় পার করেছি, পরীক্ষায় কখনো ভালো কখনো খারাপ করেছি। আব্বুর সাথে যোগাযোগ একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে, পারিবারিক অনেক সমস্যা এসেছে। কিন্তু না; আমি আর কখনো মৃত্যুর কথা ভাবি না, ভাববোও না। স্বাভাবিক মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত আমি জীবনপথ অক্ষুন্ন রাখব, যত ঝড়ই আসুক না কেন। ২০১১ এর সেই সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বরের সেই মরচে পড়া দিনগুলোর কোন পুনরাবৃত্তি আর হতে দেব না।

যারা আত্মহত্যা করেছেন, তারা আবেগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এটা আমি বলবো না। অনেক সময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। এটুকুই বলবো যারাই এই পোস্টটি পড়ছেন বা পড়বেন, জীবন ফিনিক্স পাখির মতো, ছাই থেকে বারবার জন্ম নেয়াই জীবন। আশা করি আমার পরিবার আমাকে ভুল বুঝবে না। কারণ, আমি কাউকে দোষারোপ করছি না, নট ইভেন মাই ফাদার। সবারই জীবনকে নিজের মতো করে কাটানোর অধিকার আছে। আমি কোন করুণা, দয়া ও সুবিধা পেতে ব্যক্তিগত বিষয় শেয়ার করিনি। আমার পরিচিত অনেকেই যারা হতাশায় ছিল; তাদের সাথে আমি কথা বলার চেষ্টা করি। হয়তো কেউ উপকার পায়, কেউ পায় না। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মত্মহত্যা আমাকে খুব যাতনা দিচ্ছে। তাই নিজেরটা শেয়ার করেছি।’

লেখক: নিশাত পারভেজ নিশি
শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বাংলাদেশে বিনিয়োগে অনেক চ্যালেঞ্জ : চীনা রাষ্ট্রদূত Jul 10, 2025
img
ব্রাজিলের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি ট্রাম্পের Jul 10, 2025
img
১০ জন ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দিতে রাজি হামাস Jul 10, 2025
img
তারেক রহমান এখন আরো পরিপক্ব ও যোগ্য নেতা: মান্না Jul 10, 2025
img
স্ত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার, চিকিৎসকের ওপর ক্ষেপে গেলেন কাঞ্চন Jul 10, 2025
img
ইন্টারনেট ছাড়াই চলবে হোয়াটসঅ্যাপের নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী বিটচ্যাট Jul 10, 2025
img
এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ দুপুর ২ টায় Jul 10, 2025
img
গাজায় একদিনে প্রাণ গেল আরও ৭৪ ফিলিস্তিনির Jul 10, 2025
img
শাহরুখকে ছাড়াই হারিয়ে গেল রাকেশ শর্মার বায়োপিক ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’! Jul 10, 2025
img
ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে রিয়ালকে ৪-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে পিএসজি Jul 10, 2025
img
দুপুরের মধ্যে দেশের ৭ জেলায় ৬০ কি.মি. বেগে ঝড়ের আভাস Jul 10, 2025
img
চট্টগ্রামে চুরি হওয়া স্বর্ণালংকারসহ ১ জন গ্রেফতার Jul 10, 2025
img
নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার হবে : আমিনুল হক Jul 10, 2025
img
১৩ বছর পর বলিউডে আবারও সম্পর্কের গল্প নিয়ে ফিরছে ককটেল ২! Jul 10, 2025
img
রাজকীয় ঐতিহ্য বয়ে আনা বলিউডের পাঁচ তারকা! Jul 10, 2025
img
১০০ বছরে সাকিব ১-২টা বের হয় : বিসিবি পরিচালক Jul 10, 2025
img
আইসিসি র‍্যাঙ্কিংয়ে সুখবর পেলেন বাংলাদেশের একাধিক ক্রিকেটার Jul 10, 2025
img
আগামী নির্বাচনে ৪৭ হাজার ভোটকেন্দ্র, ঝুঁকিপূর্ণ ১৬ হাজার: প্রেস সচিব Jul 10, 2025
img
সাত মাসে বাংলাদেশ ৪০ কোটি ডলারের চীনা বিনিয়োগ পেয়েছে: রাষ্ট্রদূত Jul 10, 2025
img
বন্যার কারণে ৩ শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি-সমমান পরীক্ষা স্থগিত Jul 10, 2025