চট্টগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের রয়েছে হাজার বছরের পুরাতন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমি, প্রাচ্যের রাণী বীর প্রসবিনী, আধ্যাত্মিক রাজধানী, বন্দরনগরী, আন্তর্জাতিক পর্যটন নগরী, কল্যাণময় নগরী এমন অসংখ্য নামে পরিচিত এই চট্টগ্রাম।

চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি:

চট্টগ্রামের প্রায় ৪৮টি নামের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রম্যভূমি, চাটিগাঁ, চাতগাও, রোসাং, চিতাগঞ্জ, জাটিগ্রাম, আদর্শদেশ, চট্টল, চৈত্যগ্রাম, সপ্তগ্রাম, পেন্টাপোলিস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। পণ্ডিত বার্নোলির মতে, আরবি ‘শ্যাত (খন্ড) অর্থ বদ্বীপ, গাঙ্গ অর্থ গঙ্গা নদী থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি।

অপর এক মতে ত্রয়োদশ শতকে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন বার জন আউলিয়া। তারা একটি বড় বাতি বা চেরাগ জ্বালিয়ে উঁচু জায়গায় স্থাপন করেছিলেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘চাটি’ অর্থ বাতি বা চেরাগ এবং গাঁও অর্থ গ্রাম। এ থেকে নাম হয় “চাটিগাঁও”।

এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোন্সের মতে, এ এলাকার একটি ক্ষুদ্র পাখির নাম থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম মোঘল সম্রাজ্যের অংশ হয়। আরাকানদের পরাজিত করে মোঘল এর নাম রাখেন ইসলামাবাদ। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মীর কাশিম আলী খান ইসলামাবাদকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করেন। পরে কোম্পানি এর নাম রাখেন চিটাগাং।

প্রাচীন ইতিহাস:

১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন তিন পার্বত্য জেলা এ জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৬০ সালে পার্বত্য এলাকা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গঠন করা হয়। পরবর্তীতে এ জেলা ভেঙ্গে কক্সবাজার জেলা গঠিত হয়।

প্রাচীন গ্রিক ও মিসরীয় ভৌগোলিকদের বর্ণনায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের কিছু কিছু উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের গ্রিক ভৌগোলিক প্লিনির লিখিত ‘পেরিপ্লাসে’ ক্রিস’ বলে যে স্থানটির বর্ণনা আছে খ্যাতনামা ঐতিহাসিক স্যার ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে তা সন্দ্বীপে সঙ্গে অভিন্ন। ল্যাসেনের মতে, পেন্টাপোলিস চট্টগ্রামেরই ক্লাসিক্যাল নাম।

আরব ভৌগোলিকদের বিবরণে ‘সমন্দর’ বলে যে বন্দরটির উল্লেখ আছে তা চট্টগ্রাম। সমন্দর বন্দরটি পালবংশীয় দিগ্বিজয়ী রাজা ধর্মপালের অধীনে ছিল। এ থেকে মনে হয়, ধর্মপালের রাজ্যের বিস্তৃতি চট্টগ্রাম পর্যন্ত ঘটেছিল।

প্রাচীন হরিকেল রাজ্যের কয়েকটি শিলালিপি চট্টগ্রাম জেলার উত্তরাংশে আবিষ্কৃত হওয়ায় পণ্ডিতরা মনে করেন, চট্টগ্রাম জেলার উত্তরাংশ প্রাচীন হরিকেল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সেই অঞ্চলের প্রত্ন সম্পদের ওপর নির্ভর করে ইতিহাস রচিত হয়। সেক্ষেত্রে চট্টগ্রামের পুরাকীর্তির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মোগল ঐতিহাসিক শিহাব উদ-দিন তালিশের বিবরণে তিনি চট্টগ্রামের দুর্গ এবং দুর্গের আঙিনায় পীর বদরের আস্তানার কথা উল্লেখ করেন।

তালিশের সূত্রে আরও জানা যায় যে, ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁর সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ চট্টগ্রাম জয় করে চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন। এই সুলতানের রাজত্বকালে চট্টগ্রামে নির্মিত মসজিদ এবং সমাধিসৌধ সম্পর্কেও তালিশে উল্লেখ আছে। তিনি এখানে কিছু পুরাকীর্তির খোঁজ পান।

মধ্যযুগের পুঁথি সাহিত্যের শহর চট্টগ্রামের বর্ণনায় পুরাকীর্তির উল্লেখ লক্ষ করা যায়। আনুমানিক ১৬০০-১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে রচিত দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী-মজনু কাব্যে এই বিবরণ রয়েছে। তা থেকে জানা যায় যে, এ সময়ের মনোরম চট্টগ্রাম নগরে অনেক সাধু-সজ্জনের নিবাস ছিল। উঁচু-উঁচু পর্বতে দুর্গের সীমানার মধ্যে ‘বদর আলম’-এর সমাধিসৌধের উপস্থিতির বিষয়টিও কবির নজর এড়ায়নি।

তালিশের পরে প্রায় দু’শো বছর সাহিত্যে বা লিখিত বিবরণে চট্টগ্রামের পুরাকীর্তির আর কোনো হদিস পাওয়া যায় না।

প্রাচীন মুসলিম নিদর্শন:

ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পগসন ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ‘ডিউরিং এ ট্যুর টু চাটিগাঁও’ প্রকাশিত হয়। পগসন পরিদর্শিত পুরানিদর্শনগুলি হলো- ১. পীর বদরের সমাধি, ২. নবাব আমির-উল-উমরার পাথরে তৈরি মসজিদ, ৩. ইয়াসিন খাঁর মসজিদ, ৪. সুলতান বায়েজিদ বোস্তামির দরগাহ।
এছাড়া তিনটি শিলালিপিবিহীন মসজিদের নাম উল্লেখ করেন তিনি। এগুলো হলো ১. ওয়ালি বেগ খান, ২. মির ইয়াহিয়া এবং ৩. মোল্লা সাঁই মসজিদ। পগসন তৎকালীন চট্টগ্রাম শহরের চার মাইল উত্তরে জাফরাবাদে স্যার উইলিয়াম জোন্সের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করে বাড়িটির ভূমি-নকশা ও লেখচিত্র তৈরি করেন। এছাড়া তিনি শহরে ইউরোপীয়দের কবরখানা এবং সীতাকুণ্ড পরিদর্শনের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন।

আয়তন ও সীমানা:

বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলার মোট আয়তন ৫,২৮৩ বর্গ কিলোমিটার। আয়তনের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চট্টগ্রাম জেলার মোট জনসংখ্যা ৭৯,১৩,৩৬৫ জন।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে ২১°৫৪´ থেকে ২২°৫৯´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°১৭´ থেকে ৯২°১৩´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ জুড়ে চট্টগ্রাম জেলার অবস্থান। রাজধানী ঢাকা থেকে এ জেলার দূরত্ব প্রায় ২৫৯ কিলোমিটার। এ জেলার দক্ষিণে কক্সবাজার জেলা; পূর্বে বান্দরবন জেলা, রাঙ্গামাটি জেলা ও খাগড়াছড়ি জেলা; উত্তরে ফেনী জেলা এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং পশ্চিমে নোয়াখালী জেলা ও বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। এছাড়া দ্বীপাঞ্চল সন্দ্বীপ চট্টগ্রামের অংশ।

চট্টগ্রাম জেলা ৪১ ওয়ার্ড বিশিষ্ট ১টি সিটি কর্পোরেশন, ১৫টি উপজেলা, ৩২টি থানা (উপজেলায় ১৬টি ও ১৬টি মেট্রোপলিটন থানা), ১৫টি পৌরসভা, ১৯০টি ইউনিয়ন, ৮৯০টি মৌজা ১২৬৭টি গ্রাম ও ১৬টি সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত।

১৮৬৩ সালের ২২শে জুন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি'র যাত্রা শুরু। তবে এর প্রশাসন ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৮ জন কমিশনার সমন্বয়ে পরিষদ গঠন করা হয় ১৮৬৪ সালে। ঐসময়ে চট্টগ্রাম শহরের সাড়ে চার বর্গমাইল এলাকা মিউনিসিপ্যালিটির আওতাধীন ছিল। প্রথমে ৪টি ওয়ার্ড থাকলেও ১৯১১ সালে ৫টি ওয়ার্ড সৃষ্টি করা হয়। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি ১৯৮২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সিটি কর্পোরেশনে রুপান্তরিত হয়। বর্তমানে ওয়ার্ড সংখ্যা ৪১টি। চট্টগ্রাম শহর এলাকা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন-এর অধীনস্থ।

ভাষা ও ঐতিহ্য:

বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মত চট্টগ্রাম জেলার জাতীয় ভাষা 'বাংলা' হলেও এ জেলার একটি নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে, যেটি 'চাঁটগাঁইয়া ভাষা' নামে পরিচিত। এ ভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। চট্টগ্রাম জেলার অধিকাংশ লোক এ ভাষায় কথা বলে। চট্টগ্রাম জেলা নানান লোকসংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। মুসলমান সম্প্রদায়ের মেজবান এ জেলার একটি ঐতিহ্য।

 

টাইমস/এমএএইচ/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আরব্য রজনীর রূপে নেটিজেনদের নজর কাড়লেন টিনা দত্ত Jul 06, 2025
img
সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে : আমিনুল হক Jul 06, 2025
img
আমার মনে হয়, ইলিয়াস আলীকে ভারতের কোনো একটি কারাগারে রাখা হয়েছে : এম এ মালেক Jul 05, 2025
img
দীর্ঘ বিরতির পর সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করছে ব্রিটেন Jul 05, 2025
img
শ্রীলঙ্কাকে হারানোর দিনে ৫ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্যা ম্যাচ তানভীর Jul 05, 2025
img
তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে সিরিজে ফিরল টাইগাররা Jul 05, 2025
img
বাংলাদেশে পুশইনের জন্য বিশেষ বিমানে ২০০ জনকে সীমান্তে আনল ভারত Jul 05, 2025
img
ইরান থেকে সরে গেলেন জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষকরা Jul 05, 2025
img
ফারিন খানের পোস্ট ঘিরে জল্পনা, কী ইঙ্গিত দিলেন অভিনেত্রী? Jul 05, 2025
img
টলিউডের প্রিয় ‘এজেন্ট সাই’ আবারো ফিরছে বড় পর্দায় Jul 05, 2025
img
গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্ম বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে উঠেছে : নাহিদ ইসলাম Jul 05, 2025
img
গ্ল্যামার ছেড়ে শক্তিশালী চরিত্রে মানুষী Jul 05, 2025
img
'জুলাইয়ের মতো আগামী নির্বাচনে তরুণদের নেতৃত্বে ভোট বিপ্লব ঘটবে' Jul 05, 2025
img
সেখর কম্মুলার হাত ধরে বড়পর্দায় ফের সামান্থা Jul 05, 2025
img
পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত: সুপ্রদীপ চাকমা Jul 05, 2025
img
রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে জনতা ব্যাংকের ডিজিএম নিখোঁজ Jul 05, 2025
img
সকাল ৯টার মধ্যে দেশের ৭ জেলায় ৬০ কি.মি. বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস Jul 05, 2025
img
বাংলাদেশের ৩৬৫ রানের ইনিংসের রেকর্ড ভেঙে দিল ইংল্যান্ড Jul 05, 2025
img
ম্যাক্সওয়েলের দুর্দান্ত বোলিংয়ে জয় পেল ওয়াশিংটন Jul 05, 2025
আজান শুনে যেভাবে জবাব দিবেন Jul 05, 2025