উত্তর প্রদেশ রাজ্যে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তিনজনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘিরে ভারতে চলছে বিতর্ক। ওই তিন যুবক একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। তবে তাদের চলন্ত গাড়ি একটি অসম্পূর্ণ সেতু থেকে হঠাৎই নদীর শুষ্ক তলদেশে পড়ে যায়। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, রোববারের (২৪ নভেম্বর) ওই দুর্ঘটনায় গাড়ির চালক সম্ভবত গুগল ম্যাপস-এর দিকনির্দেশ অনুসরণ করছিলেন। এই সেতুটির একটি অংশ আগেই বন্যায় ধ্বসে পড়ে। তবে এলাকাবাসীরা বিষয়টি জানলেও, বাইরের কেউ তা জানার সুযোগ পাননি। সেতুটির ধ্বংসাবশেষে কোনও ব্যারিকেড বা সাইনবোর্ডও ছিল না।
দুর্ঘটনার জন্য স্থানীয় সড়ক বিভাগের চার প্রকৌশলী এবং গুগল ম্যাপস-এর এক অজ্ঞাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে 'অবহেলাজনিত হত্যার (কালপাবল হোমিসাইড) অভিযোগ আনা হয়েছে। খবর বিবিসির।
এইসব দুর্ঘটনা ভারতে সড়ক অবকাঠামোর দুর্বলতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে গুগল ম্যাপস বা অন্য ন্যাভিগেশন অ্যাপ দায়ী কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সমস্যা বা দুর্ঘটনার মূলে রয়েছে সরকারের অবহেলা। অসম্পন্ন সেতু বা দুর্ঘটনা কবলিত স্থানটি আগেই সঠিকভাবে চিহ্নিত করে ব্যারিকেড দেয়া হলে, হয়তো এমন মর্মান্তিক ঘটনা এড়ানো যেত।
গুগল ম্যাপস ও পথনির্দেশক হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা: ভারতে গুগল ম্যাপস সবচেয়ে জনপ্রিয় ন্যাভিগেশন অ্যাপ। কমপক্ষে ৬ কোটি সক্রিয় ব্যবহারকারী এই অ্যাপের ওপর নির্ভর করেন। তবে এই অ্যাপটি প্রতিনিয়তই ভুল দিকনির্দেশ দেয়ার অভিযোগে সমালোচনার মুখে পড়ে।
ভারতে চলন্ত গাড়ি একটি অসম্পূর্ণ সেতু থেকে হঠাৎই নদীর শুষ্ক তলদেশে পড়ে যায়।
ভারতে চলন্ত গাড়ি একটি অসম্পূর্ণ সেতু থেকে হঠাৎই নদীর শুষ্ক তলদেশে পড়ে যায়।
উদাহরণস্বরূপ ২০২১ সালে মহারাষ্ট্রে এক ব্যক্তি তার গাড়ি চালিয়ে একটি বাঁধ পাড়ি দিয়ে পানিতে পড়ে ডুবে যান। অভিযোগ ছিল, তিনি গুগল ম্যাপের দিকনির্দেশ মেনে এগোচ্ছিলেন। ২০২২ সালে কেরালায় গাড়ি চালিয়ে দুই চিকিৎসক একটি নদীতে পড়ে মারা যান। সেসময়ও অভিযোগ ওঠে যে তারা গুগল ম্যাপস দেখে গাড়ি চালাচ্ছিলেন।
কেন এমন ভুল হয়: জিপিএস প্রযুক্তি মূলত ব্যবহারকারীদের ডেটা (তথ্য) ব্যবহার করে ট্র্যাফিকের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। যেসব সড়কে ট্র্যাফিক কম, সেগুলো ব্যবহারে অ্যাপটি বেশি পরামর্শ দেয়। তবে সড়কের অবস্থা বা রক্ষণাবেক্ষণের তথ্য প্রতিনিয়ত আপডেট করার দায়িত্ব মূলত স্থানীয় কর্তৃপক্ষের।
ভারতে এই ধরনের তথ্য সরবরাহ ও আপডেটের জন্য নির্ভরযোগ্য কোনও ব্যবস্থা নেই। পোটার ম্যাপ-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং গুগল ম্যাপসের সাবেক কর্মী আশিষ নাইর জানান, গুগল ম্যাপসের মতো একটি বিশ্বব্যাপী প্ল্যাটফর্মের পক্ষে প্রতিটি সড়কে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন নজর রাখা প্রায় অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, ভারতের দ্রুত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও জনসংখ্যার বিশালতার কারণে সময়মতো সঠিক তথ্য সংগ্রহ এবং শেয়ার করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।'
আইনি অবস্থান: আইনজীবী সাইমা খান বলেন, ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইন (আইটি অ্যাক্ট) অনুসারে গুগল ম্যাপস একটি 'ইন্টারমিডিয়ারি' (তৃতীয় পক্ষের সরবরাহকৃত তথ্য প্রচারকারী প্ল্যাটফর্ম) প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়মুক্ত। তবে যদি প্রমাণিত হয় যে অ্যাপটিকে সঠিক তথ্য দেয়া হয়েছিল এবং তারা তা উপেক্ষা করেছে, তাহলে তাদের সেই অবহেলার জন্য দায় এড়াতে পারে না।
বাংলাদেশে গুগল অ্যাপস ব্যবহারকারীর সংখ্যা: দেশে গুগল অ্যাপস যেমন গুগল ম্যাপস, জিমেইল, গুগল ড্রাইভ, গুগল সার্চ, ইউটিউভের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে।
২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা আনুমানিক ১৩ কোটি। এর মধ্যে ৮০-৯০ শতাংশ ব্যবহারকারী কোনো না কোনোভাবে এককভাবে গুগলের সেবার ওপর নির্ভরশীল। একইসঙ্গে গুগল ম্যাপসের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, কারণ রাইড-শেয়ারিং সার্ভিস যেমন উবার, পাঠাও এবং ফুড ডেলিভারি সার্ভিস যেমন ফুডপান্ডা তাদের দিকনির্দেশের জন্য গুগল ম্যাপস ব্যবহার করে।
গুগল অ্যাপস ব্যবহারের সুবিধা: দেশে গুগল অ্যাপসের জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে এর বহুমুখী সুবিধা। দিকনির্দেশ এবং নেভিগেশনের ক্ষেত্রে গুগল ম্যাপস শহরাঞ্চলে চলাচলের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। সেইসঙ্গে জিমেইল এবং গুগল মিট অফিসিয়াল এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য খুবই জনপ্রিয়।
ভিডিও কন্টেন্ট মাধ্যম ইউটিউব বিনোদন, শিক্ষা এবং অন্যান্য অনেক বিষয়ে দেশবাসীর কাছে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
ক্লাউড স্টোরেজ হিসেবে গুগল ড্রাইভ ব্যক্তিগত এবং অফিস ফাইল সংরক্ষণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে গুগল অ্যাপসের ব্যবহারে দেশে সংকট ও সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগের মান খারাপ এবং দুর্বল। উচ্চগতির ইন্টারনেট ছাড়া গুগল ম্যাপস বা ড্রাইভের মতো অ্যাপস ব্যবহার করতে সমস্যা হয়।
ডেটা নির্ভরতা এবং রিয়েল-টাইম আপডেটের অভাব প্রায়ই বাংলাদেশের ছোট শহর ও গ্রামাঞ্চলের রাস্তার ভুল তথ্য দেখায়। অনেক সময় নতুন রাস্তা বা ব্রিজের অবস্থান সঠিকভাবে আপডেট করা হয় না।
একইসঙ্গে গুগল অ্যাপসের বেশিরভাগ ইন্টারফেস ইংরেজি ভাষাভিত্তিক। এক্ষেত্রে গণপরিবহন এবং ট্রাক-লরির অনেক চালক বা ব্যবহারকারী অনেকটা বিড়ম্বনায় পড়েন। অনেক ব্যবহারকারী প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ না হওয়ায় গুগল অ্যাপসের সব সুবিধা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হন। সরকারি সহযোগিতার অভাবে দেশে রাস্তা বা অবকাঠামোর তথ্য সঠিকভাবে গুগল ম্যাপসের মতো প্ল্যাটফর্মে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগের কমতি রয়েছে। বিভিন্ন নতুন প্রকল্পের তথ্য (যেমন নতুন সেতু বা সড়কের অবস্থা) আপডেট করতে গড়িমসি করে থাকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।