‘পাওয়া’ চাকরি হারিয়ে হতাশায় ২২৭ জন

৪৩তম বিসিএসে চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়া প্রায় দুই হাজার প্রার্থীর মধ্যে ২২৭ জনের ভাগ্য প্রায় তিন মাস ধরে ঝুলে আছে।

‘দুই-তিন দিনের মধ্যে’ নিয়োগের আশ্বাস দেওয়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দুই-তিন মাস পরে এসে বলছে, ‘বিষয়টি আন্ডার প্রসেস’।

বাদ পড়া প্রার্থীরা বলছেন, দীর্ঘ চেষ্টা ও প্রতীক্ষার পর ‘পাওয়া’ চাকরির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। দু-একজন আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন।

বাদ পড়াদের একজন পরেশ চন্দ্র পাল, লেখাপড়া সম্পন্ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

তিনি বলেন, “আমার অতটা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। আর জুলাই আন্দোলনে সামনের সারি থেকে ভূমিকা রেখেছি।

“কিন্তু কোন কারণে, কেন আমার নাম বাদ রাখা হল, আমি আজও বুঝতে পারিনি। ইতোমধ্যে আমাদের সহকর্মীরা চাকরিতে যোগ দিয়ে তিন মাস পার করেছেন; আর আমরা আছি চরম অনিশ্চয়তায়।”

৪৩তম বিসিএসের ২১৬৩ জন প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে ২২৭ জনের বিষয়ে ‘বিরূপ মন্তব্য’ আসায় তাদের সাময়িকভাবে বাদ রেখে গত ৩০ ডিসেম্বর ১৮৯৬ জন প্রার্থীকে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

সরকার যে ২২৭ জনের নিয়োগ স্থগিত রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোও প্রকাশ করেনি। ফলে এ নিয়ে শুরু হয় নানা সমালোচনা।

গত জানুয়ারির শুরু থেকেই বাদ পড়া চাকরিপ্রত্যাশীরা সচিবালয়ের সামনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন।

এর মধ্যে গত ৯ জানুয়ারি তারা জনপ্রশাসন সচিব বরাবর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন।

আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন সচিব মোখলেছ উর রহমান সেদিন একটি ব্রিফিং করেন।

তিনি বলেন, পরীক্ষায় বাদ পড়া চাকরিপ্রত্যাশীদের একটা অংশকে ‘ফৌজদারি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধের ইতিহাস না থাকা সাপেক্ষে’ সরকার নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।

“ফৌজদারি কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ, স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিষ্কৃত হয়েছিল অথবা এমন কোনো হিডেন অপরাধ করেছে, যেটা সামনে আসছে- এমন ছাড়া অন্যদের নিয়োগপ্রাপ্তি শুধু একটি প্রক্রিয়ার ব্যাপার, তারা এটি পাবে।”

ফাইল প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ঘুরে এলে ‘দুই-তিন দিনের মধ্যে’ নতুন নিয়োগের তালিকা প্রকাশ করা হবে বলেও সচিব সেদিন আশ্বাস দেন।

মার্চ মাসের শেষে এসে জনপ্রশাসন সচিব মোখলেছ উর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার জনসংযোগ কর্মকর্তা মানসুর হোসেন বলেন, “স্যার বিষয়টি নিয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব উজ্জল হোসেনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন।”

এ বিষয়ে ‘নব-নিয়োগ’ শাখার কর্মকর্তা উজ্জল হোসেন বলেন, “এত বড় বিষয় নিয়ে কথা বলার এখতিয়ার আমার নেই।”

পরে আবার জনপ্রশাসন সচিবের কাছে গেলে তিনি একান্ত সচিব মোহাম্মদ বারিউল করিম খানের মাধ্যমে বার্তা দেন, ‘বিষয়টি আন্ডার প্রসেস’।

‘অনেক কষ্টের গল্প আছে’


বাদ পড়া আরেক চাকরিপ্রত্যাশী রায়হান উদ্দিন, যিনি নির্বাচিত হয়েছেন শিক্ষা ক্যাডারে।

তিনি বলেন, “প্রচণ্ড হতাশায় আমাদের তিনজন সম্প্রতি সুইসাইড এটেম্পট নিয়েছিল। চাকরি পেয়েও কী কারণে তা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে- এ হতাশায় অনেকেই এখন মৃতপ্রায়।

“এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে কেউ যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটায়, সেটার দায়ভার কে নেবে?”

বাদপড়া আরেক প্রার্থী নাফিস সাদিক বলেন, “২০২০ সাল থেকে পরিশ্রম শুরু করে ২০২৩ সালে সুপারিশ; এরপর ২০২৪ সালে গেজেট হওয়ার পরও বাদ পড়া- একটা মানুষের মনের অবস্থা একটু চিন্তা করেন।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক করা মাসুমা আক্তার মিনি বলেন, “২০১৭ সাল থেকে প্রস্তুতি নিয়ে ২০২৪ সালে এসে একটা বিসিএস চাকরি অর্জন করার পেছনে অনেক ত্যাগ ও কষ্টের গল্প আছে।

“পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুলের চাকরিটা ছেড়েছিলাম। প্রথম প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার দেড় ঘণ্টা আগে পড়ে গিয়ে ডান হাতের কনুই ভেঙে যায়। তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করে ওই ভাঙা হাতে পরীক্ষা দিয়ে এতোদূর এসেছিলাম।”

মাসুমা বলেন, “৪৩তম বিসিএসটা আমার সাধের বিসিএস; ত্যাগ আর সংগ্রামের বিসিএস। আজ আমাদের ১৮৯৬ জন সহকর্মী ঈদের বেতন-বোনাস নিয়ে বাড়ি ফিরছে। আর আমরা চাকরিটাও পেলাম না।

“কেন আমাদের ভাইয়েরা আজ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে চাচ্ছেন, এমন জীবন কি আমরা ডিজার্ভ করি?”
কী ঘটেছিল?

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বরে। এতে ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯০ জনের আবেদন জমা পড়ে।

কোভিড মহামারীর মধ্যে ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়; অংশ নেন ৩ লাখ ২১ হাজার ৬৫০ জন।

২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার মিলে ২ হাজার ৮০৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। তাদের মধ্যে ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য অপেক্ষমান ছিলেন ২ হাজার ১৬৩ জন।

বাদ পড়াদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত ৬ জানুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তিতে বলে, ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সাময়িকভাবে ২১৬৩ জন প্রার্থীকে মনোনীত করে ২০২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সুপারিশ করে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে প্রার্থীদের ‘প্রাক-চরিত্র যাচাই-বাছাই’ করে ২১৬৩ জনের মধ্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ৪০ জনকে বাদ দেওয়া হয়। এজেন্সি রিপোর্ট বিবেচনায় বাদ দেওয়া ৫৯ জনকে। বাকি ২০৬৪ জনের বিষয়ে ১৫ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি হয়।

“প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এ নিয়োগের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ২১৬৩ জন প্রার্থীর বিষয়ে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়।”

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গোয়েন্দা তথ্যে ২২৭ জনের বিষয়ে ‘বিরূপ মন্তব্য’ পাওয়া যায়। সে কারণে তাদের ‘সাময়িকভাবে নিয়োগের জন্য অনুপযুক্ত’ বিবেচনা করা হয়েছে।

তবে ‘অনুপযুক্ত’ বিবেচিত কেউ পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে তা নেওয়া হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।

এফপি/এস এন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে ইউলের ভাগ্য নির্ধারণ শুক্রবার Apr 02, 2025
img
গাজায় জাতিসংঘ চালিত ক্লিনিকে বিমান হামলা, বহু হতাহত Apr 02, 2025
img
কেউ কেউ নব্য ফ্যাসিবাদী হিসেবে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে : শিবির সভাপতি Apr 02, 2025
img
কোনো ষড়যন্ত্র জামায়াতের অগ্রযাত্রা থামাতে পারবে না : গোলাম পরওয়ার Apr 02, 2025
img
নারী ক্রিকেট কোথায় পিছিয়ে জানালেন বাংলাদেশ অধিনায়ক Apr 02, 2025
img
সাফ অ্যাথলেটিক্স নয়, জ্যোতিদের বিশ্বকাপের সঙ্গী অলিম্পিয়ান জুই Apr 02, 2025
img
বিমসটেকের পরবর্তী চেয়ারম্যান হচ্ছেন ড. ইউনূস Apr 02, 2025
img
সহকর্মীদের সম্মান পেতে যা করবেন Apr 02, 2025
img
গরমে স্বস্তি দেবে অ্যালোভেরার জুস, আরো যে উপকার Apr 02, 2025
img
নেতানিয়াহুকে গ্রেফতারের আহ্বান জানাল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ Apr 02, 2025