শুল্ক হার কমাতে সংস্কার প্রতিশ্রুতির সদিচ্ছাকে কাজে লাগাতে হবে: ড. জাহিদ হোসেন

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আজ বলেছেন, সম্মিলিত শুল্ক হার কমানোর লক্ষ্যে পরিবর্তনগুলি চূড়ান্ত করে তা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে সংস্কার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে সৃষ্ট সদিচ্ছাকে কাজে লাগাতে হবে, যা আরও অনুকূল বাণিজ্য সম্পর্ক নিশ্চিত করবে।

১৯৩০ দশকের মহামন্দার পর থেকে প্রায় সকল মার্কিন শুল্ক উদারীকরণের বিপরীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যাপক পারস্পরিক শুল্ক চালু করার পর ড. জাহিদ এই মন্তব্য করেন।

বাসসের সাথে আলাপকালে, বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, একক নির্বাহী পদক্ষেপের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গড় শুল্ক ২.৫% থেকে ২০% এ উন্নীত হয়েছে। এই পদক্ষেপটি ১৯৩০ সালের স্মুট-হাওলি ট্যারিফের মতো একটি বিশ্বব্যাপী শুল্ক যুদ্ধের সূত্রপাতের ইঙ্গিত দেয়, যখন ২০,০০০ আমদানিকৃত পণ্যের উপর ২০% শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল।

আমেরিকান কৃষক ও ব্যবসাগুলিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এ পদক্ষেপ নেয় হলেও এর অপ্রত্যাশিত পরিণতি মহামন্দাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। এই আইনের ফলে অন্যান্য দেশ থেকে প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, যা ১৯২৯ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে ৬৭% হ্রাস করেছিল।

তিনি বলেন, পারস্পরিক শুল্ক মার্কিন রপ্তানির উপর আরোপিত সর্বোচ্চ পর্য়ায়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য মার্কিন শুল্ক হার নির্ধারণ করে যা সম্ভাব্য হ্রাস নির্দিষ্ট চাহিদা পূরণের উপর নির্ভরশীল।

বস্ত্র ও পোশাক খাত ইতোমধ্যেই কিছু সর্বোচ্চ মার্কিন শুল্কের বোঝার চাপে রয়েছে এবং এখনও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। পিউ রিসার্চ বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক ও পাদুকা আমদানির উপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে আরোপিত উচ্চ কর হারের বিষয়টি তুলে ধরেছে।

ড. জাহিদ বলেন, ইউএসটিআরের অনুমান অনুসারে, বাংলাদেশে মার্কিন আমদানির বিরুদ্ধে শুল্ক, প্যারা-ট্যারিফ এবং শুল্ক-বহির্ভূত বাধার সমতুল্য হার হচ্ছে ৭৪%। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাংলাদেশ সহ সকল দেশকে ৫০% "দয়ালু পারস্পরিক শুল্ক ছাড়" প্রদান করে উদারতা দেখিয়েছেন বলে দাবি করেছেন।

মার্কিন বাণিজ্য নীতিতে এই পরিবর্তনের মধ্যে, একটি আশাব্যঞ্জক দিক রয়েছে: প্রতিযোগীরা একই রকম বা তার চেয়েও বেশি পারস্পরিক শুল্কের মুখোমুখি হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনাম ৪৬%, ভারত ২৬%, কম্বোডিয়া ৪৯%, শ্রীলঙ্কা ৪৪%, থাইল্যান্ড ৩৬%, পাকিস্তান ২৯%, মিয়ানমার ৪৪%, লাওস ৪৮%, চীন ৩৪% এবং ইন্দোনেশিয়া ৩২% শুল্ক দিতে হবে। ভারতের ২৬% এবং পাকিস্তানের ২৯% খুব বেশি ব্যবধান নয়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলকতা মূলত অপরিবর্তিত রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ফলে বিশ্বব্যাপী চাহিদা সংকোচনের সম্ভাবনার মুখে এটি খুব একটা স্বস্তি দেয় না। যদি প্রতিপক্ষের পাল্টা পদক্ষেপের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, তাহলে ট্রাম্প এই বছরের শুরুতে কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের মতো তার পথ পরিবর্তন করবেন কিনা তা অনিশ্চিত।

এ মুহূর্তে অগ্রাধিকারের বিষয় হলো ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ, কারণ পারস্পরিক শুল্ক ইতিমধ্যেই কার্যকর করা হয়েছে, সাবলীলভাবে পরিবর্তনের জন্য কোনও সময় দেওয়া হয়নি। এমনকি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পথে রয়েছে এমন পণ্যগুলিতেও নতুন শুল্ক আরোপ করা হবে, যা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছে যে: এই খরচ কে বহন করবে?

তিনি বলেন, "আমাদের কৌশলের লক্ষ্য হওয়া উচিত ক্রেতাদের উপর শুল্কের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া। একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হল ক্রেতাদের সীমিত বিকল্প রয়েছে, কারণ আমাদের অনেক প্রতিযোগী একই রকম বা এমনকি উচ্চতর পারস্পরিক শুল্কের মুখোমুখি হচ্ছে।"

তিনি বলেন, বিক্রেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে, যার ফলে ওয়াল-মার্ট এবং টার্গেটের মতো পাইকারি ক্রেতারা শুল্কের খরচ আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়।
তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি মোকাবিলায়, বিক্রেতাদের জন্য সম্মিলিতভাবে সম্মত হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, শুল্ক কমানোর জন্য দাম হ্রাস মেনে না নেওয়া উচিত। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলিকে অবশ্যই পুনঃআলোচনাকৃত মূল্যের উপর নিবিড় নজরদারি করতে হবে এবং এই সম্মত অবস্থান মেনে না চলার জন্য জরিমানা আরোপ করতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, ‘এ ছাড়াও, আমাদের রপ্তানিকে কম দামের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে শুল্ক ছাড়ের জন্য যোগ্যতা অর্জনের সম্ভাবনা অন্বেষণ করা উচিত।’

ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, ড. জাহিদ বলেন, ‘বাংলাদেশকে মার্কিন আমদানিতে ৭৪% সম্মিলিত শুল্ক হার মোকাবিলা করতে হবে। এই শুল্কের বৈধতা পারস্পরিক হোক বা শাস্তিমূলক হোক তা ইউএসটিআরের গণনার নির্ভুলতার উপর নির্ভর করে। ধারণা করা হচ্ছে যে, ইউএসটিআর সম্মিলিত শুল্ক হার গণনা করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে মার্কিন আমদানি দ্বারা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতিকে কেবল বিবেচনা করেছে।’

তিনি বলেন, যেমন বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৬.২ বিলিয়ন ডলার, এবং বাংলাদেশ থেকে মার্কিন আমদানি ২০২৩ সালে ছিল মোট ৮.৪ বিলিয়ন ডলার। শতাংশ হিসাবে প্রকাশ করলে তা ৬.২/৮.৪ অনুপাত ৭৪ এর সমান।

এই পদ্ধতির সামঞ্জস্য বোঝা কঠিন। তবুও, এটা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশে গড় শুল্ক ১৪.৮%, এবং প্যারা-শুল্ক অন্তর্ভুক্ত করলে প্রায় দ্বিগুণ। অ-শুল্ক বাধার সীমাবদ্ধতা, যার গড় প্রায় ২০০% (বিশ্বব্যাংক, চেঞ্জ অফ ফ্যাব্রিক ২০২২) সমতুল্য, যা শুল্কের চেয়ে অনেক বেশি।

এই বাধাগুলির মধ্যে রয়েছে ভারী স্যানিটারি এবং ফাইটোস্যানিটারি প্রয়োজনীয়তা, বাণিজ্যে প্রযুক্তিগত বাধা, প্রাক-শিপমেন্ট পরিদর্শন, অ-স্বয়ংক্রিয় লাইসেন্সিং প্রয়োজনীয়তা এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।

ইউএসটিআর -এর ২০২৫ সালের বৈদেশিক বাণিজ্য বাধা প্রতিবেদনটি একটি আলোচনার নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে, যা মার্কিন আমদানির উপর সম্মিলিত শুল্ক হার কমাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরে।
প্রতিবেদনটি অন্তর্বর্তী সরকারের এই বিষয়গুলির স্বীকৃতি এবং সংস্কারের প্রতিশ্রুতি স্বীকার করে। উদাহরণস্বরূপ, এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অন্তর্বর্তী সরকার মার্কিন কোম্পানিগুলির সাথে আনুষ্ঠানিক পরিশোধ চুক্তিতে সম্মত হয়েছে এবং বিনিয়োগ-সম্পর্কিত মূলধন প্রত্যাবাসনের জন্য আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজতর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মার্কিন শিল্পকে রক্ষা এবং বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা সংশোধনের জন্য এই নীতিকে ন্যায্যতা দিয়েছেন এবং জোর দিয়ে বলেছেন যে, অন্যান্য দেশগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অন্যায্য আচরণ করেছে।
নতুন শুল্ক ব্যবস্থা অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন ৩৭% পারস্পরিক শুল্কের মুখোমুখি। ২০২৩ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি আমদানিতে গড়ে ১৫.৭% শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, যার ফলে ৮.২৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্যের উপর ১.০২ বিলিয়ন ডলার শুল্ক আদায় হয়েছিল। বাংলাদেশের বাণিজ্য নীতি এবং রাজস্ব আদায়ে শুল্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেখানে গড়ে ১৪.৮% এমএফএন শুল্ক প্রযোজ্য।

কৃষি পণ্যগুলি ১৮.১% হারে উচ্চ সুরক্ষার সম্মুখীন, যেখানে অ-কৃষি পণ্যের জন্য ১৪.১% হারে সুরক্ষা প্রদান করা হয়।

এফপি/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
কক্সবাজার-মহেশখালী নৌরুটে পরীক্ষামূলক সি-ট্রাক চলাচল শুরু Apr 18, 2025
img
সংস্কার ও হাসিনার বিচারের আগে কোনো নির্বাচন নয় : গোলাম পরওয়ার Apr 18, 2025
img
অপহরণের পর কিশোরীকে ধর্ষণ, অভিযুক্ত শিক্ষক গ্রেফতার Apr 18, 2025
img
পশ্চিমবঙ্গে সহিংসতা নিয়ে বাংলাদেশের মন্তব্য ‘অযৌক্তিক’ : ভারত Apr 18, 2025
img
পাঞ্জাবের ১৪টি গ্রেনেড হামলার মাস্টারমাইন্ড ধরা পড়লেন আমেরিকায় Apr 18, 2025
img
আগ্রহ দেখায়নি বেসরকারি চ্যানেল, বিটিভি দেখাবে বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে সিরিজ Apr 18, 2025
img
ঘরোয়া ক্রিকেটেও রান পাচ্ছেন না মাহমুদউল্লাহ Apr 18, 2025
img
রাজধানীতে চাপাতি ঠেকিয়ে ছিনতাই, যুবক গ্রেফতার Apr 18, 2025
img
জুমার দিনের যে সময় দোয়া কবুল হয় Apr 18, 2025
img
সঠিক সমালোচনা করুন কিন্তু গুজব ছড়াবেন না : ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব Apr 18, 2025