বেনামি ঋণের তালিকায় প্রথম এস আলম গ্রুপ, দ্বিতীয় বেক্সিমকো

ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে নিবন্ধন করা প্রতিষ্ঠান বা একেবারেই অস্তিত্বহীন কোম্পানির নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক খাতে সাতটি বড় শিল্প গ্রুপের কমপক্ষে পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার বেনামি ঋণের সন্ধান মিলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেনামি ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে। এর পরেই রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের নাম। এ প্রক্রিয়ায় আরও রয়েছে নাবিল গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, আরামিট গ্রুপ ও সিকদার গ্রুপ। আরও একটি গ্রুপের নামে আমদানির আড়ালে বেনামি ঋণের সন্ধান মিলেছে। সেগুলোর বিষয়ে বিশদ তদন্ত হচ্ছে।

ঋণের একটি অংশ নেওয়া হয়েছে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে আমদানির নামে। ঋণ নিতে ব্যাংক কর্মকর্তারা গ্রুপগুলোকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছে। ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। সেগুলো এখন আদায় না হওয়ায় খেলাপি হচ্ছে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে লুটপাটের বিষয়ে চলমান কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) বিশেষ তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তদন্ত কার্যক্রম যতই এগোচ্ছে, ততই লুটপাটের নতুন নতুন তথ্য যেমন বের হচ্ছে, তেমনই বের হচ্ছে বেনামি ঋণের তথ্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএফআইইউ ঋণের নথিপত্র, লেনদেনের ধরন এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে বেনামি ঋণের মূল সুবিধাভোগী কারা, সেগুলো বের করছে। এর ভিত্তিতে বেনামি ঋণ সংশ্লিষ্টদের নামে দেখানোর নির্দেশ দিচ্ছে।

ভুয়া বা অস্তিত্বহীন কোম্পানির নামে নেওয়া কোনো ঋণকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএফআইইউ বেনামি হিসাবে রাখছে না। সেগুলোর সুবিধাভোগীদের বের করে ঋণের দায় তাদের নামে দেখানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিচ্ছে। কয়েকটি গ্রুপ বেশকিছু বেনামি ঋণের দায় স্বীকার করে নিয়েছে। এর মধ্যে বেক্সিমকো, নাবিলসহ আরও দুটি গ্রুপের নাম রয়েছে।

সবচেয়ে বেশি বেনামি ঋণ নিয়েছে সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বলে পরিচিত এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল ইসলাম মাসুদ। তার বেনামি ঋণ ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ বেনামি ঋণ নিয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন আরামিট গ্রুপ বেনামে ঋণ নিয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদার বেনামে ঋণ নিয়েছেন দেড় হাজার কোটি টাকা। সিকাদার গ্রুপের বেনামি ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। নাবিল গ্রুপের নামে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বেনামি ঋণ রয়েছে।

সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বলে পরিচিত আরও একটি গ্রুপের বেনামি ঋণের ৬০০ কোটি টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আরও তদন্ত হচ্ছে।

২০০২ সাল থেকে দেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন কার্যকর করা হয়েছে। এর আওতায় প্রণীত বিধিমালা অনুযায়ী ব্যাংক হিসাব খুলতে গেলে গ্রাহকের পরিচিতি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্তৃক নিশ্চিত করতে হবে। গ্রাহকের পরিচিতি নিশ্চিত হলে বেনামি হিসাব খোলার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও ব্যাংকগুলোয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহায়তায় বেনামি হিসাব খুলে গ্রাহকদের আমানতের টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারাই।

এখন পর্যন্ত তদন্তের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এস আলম গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে ২ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকাই নিয়েছে বেনামে। সরাসরি ঋণ ৯৮ হাজার কোটি টাকা এবং পরোক্ষ ঋণ বা বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকিং উপকরণের (এলসি, ব্যাংক গ্যারান্টি, আগাম চেক প্রদান, রপ্তানি বিল বিক্রি ইত্যাদি) মাধ্যমে নিয়েছে ৩৪ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকিং উপকরণের মাধ্যমে নেওয়া ঋণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ না করায় সেগুলো এখন পরোক্ষ ঋণে পরিণত হচ্ছে। একই সঙ্গে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। যেগুলো পাচার করা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রুপের মোট ঋণের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৪৬ শতাংশই নেওয়া হয়েছে বেনামে।

ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলে বা অন্যের নামে কোম্পানি খুলে এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আগে ঋণের অর্থ ছাড় করা হয়েছে। পরে ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী কাগজপত্র সরবরাহ করা হয়েছে বৈধতার আবরণ দিতে। এমন সব প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া ঋণের মূল সুবিধাভোগী ছিল এস আলম গ্রুপ। যে কারণে ওইসব ঋণ এই গ্রুপের নামে দেখানো হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত তদন্তে বেক্সিমকো গ্রুপের নামে-বেনামে ১৮৮টি কোম্পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ৭৮টি কোম্পানিকে ব্যবহার করেছে। গ্রুপটির নামে মোট ঋণ কত, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত গ্রুপের নামে খেলাপি ঋণের পরিমাণই ৫৩ হাজার কোটি টাকা। মোট ঋণ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে। এর মধ্যে ২২ হাজার কোটি টাকা বেনামি ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে গ্রুপের মোট ঋণের ৩৭ শতাংশই বেনামে নেওয়া হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপ শুধু নিজস্ব কোম্পানির নামেই ঋণ নিত না। অন্য গ্রুপের কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে তার মূল সুবিধাভোগী ছিল বেক্সিমকো গ্রুপ। এমন নজিরও অনেক পাওয়া গেছে, ঋণের টাকা তোলার আগে হিসাব খোলা হয়েছে। আবার ঋণের টাকা নগদে তোলার পর হিসাবটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে গ্রুপটি জালিয়াতি করেছে। এ ধরনের বেশকিছু জালিয়াতির ঘটনা শনাক্ত হওয়ার পর কিছু বেনামি ঋণের দায় গ্রুপটি চিঠি দিয়ে স্বীকার করে নিয়েছে।

নাবিল গ্রুপের নামে মোট ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে ভুয়া বা বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ রয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। মোট ঋণের ৭০ দশমিক ৩৭ শতাংশই নেওয়া হয়েছে বেনামে। নাবিল গ্রুপ এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক থেকেই ঋণের সিংহভাগ নিয়েছে।

এখন পর্যন্ত তদন্তে নাসা গ্রুপের দেড় হাজার কোটি টাকা বেনামি ঋণের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলোর বেশির ভাগই নেওয়া হয়েছে ভুয়া কোম্পানির নামে। তবে এসব ঋণের মূল সুবিধাভোগী নাসা গ্রুপ। যে কারণে বেনামি ঋণগুলো নাসা গ্রুপের নামে দেখানো হচ্ছে।

আরামিট গ্রুপের বেনামি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার কেটি টাকার বেশি। এসব ঋণের বড় অংশই নেওয়া হয়েছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী পরিবারের মালিকানাধীন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে। যে ব্যক্তি বা কোম্পানির নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে, তারা এসব ঋণের বেশির ভাগ সুবিধাই ভোগ করেননি। সুবিধা ভোগ করেছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী।

যে কারণে এসব ঋণকে সাইফুজ্জামানের ঋণ হিসাবে দেখানোর পদক্ষেপ নিয়েছে ব্যাংকটি। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ইউসিবির পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেওয়া হয়েছে।

সিকদার গ্রুপের এখন পর্যন্ত ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা বেনামি ঋণের তথ্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে। ঋণের বড় অংশই নেওয়া হয়েছে তাদেরই মালিকানাধীন ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যাংকটির পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেওয়া হয়েছে। সিকদার গ্রুপের নামে বেনামি ঋণের একটি বড় অংশ গেছে আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ-সদস্য আসলামুল হকের মালিকানাধীন মাইশা গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির নামে। ওই কোম্পানির নামে ঋণ নেওয়া হলেও এর মূল সুবিধাভোগী ছিল সিকদার গ্রুপ। আরও বিভিন্ন গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকগুলোয় বেনামি ঋণ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এসব তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে।

এসএম/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
কিছু কিছু ম্যাচ সারা জীবন মনে থাকে: মোহাম্মদ সিরাজ Jul 16, 2025
img
ঘুষ দিতে গিয়ে মালয়েশিয়ায় এয়ারপোর্টে দুই বাংলাদেশি আটক Jul 16, 2025
img
‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার Jul 16, 2025
img
অভিনেতা রবি তেজার বাবা আর নেই Jul 16, 2025
img
ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে রেখে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় : বিআরটিএ চেয়ারম্যান Jul 16, 2025
img
বিসিবি এবার টাইগারদের জন্য নিয়োগ দিল ‘পাওয়ার হিটিং’-এর জনক Jul 16, 2025
img
লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে ক্রিকেটের সময়সূচি ঘোষণা Jul 16, 2025
img
ওমান সাগরে ২০ লাখ লিটার তেলসহ ট্যাংকার জব্দ করলো ইরান Jul 16, 2025
img
ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধি ও দাম কমাতে কাজ করছে সরকার: ফয়েজ আহমদ Jul 16, 2025
img
বিমানবন্দরের মারাত্মক ভুলে করাচির যাত্রী পৌঁছে গেলেন সৌদি Jul 16, 2025
img
কন্যাসন্তান পেয়ে জীবন বদলে গেল: সিদ্ধার্থ Jul 16, 2025
img
র‍্যান্ডম পদ্ধতিতে ১৫ হাজার ৪৯৪টি আয়কর রিটার্ন অডিটে এনবিআরের নির্বাচন Jul 16, 2025
img
‘স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার’ তিন তারকাই এখন কন্যার বাবা-মা Jul 16, 2025
img
বিনোদিনী চরিত্রেই নিজেকে খুঁজে পেলেন শুভশ্রী Jul 16, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করতে ইরানকে আগস্ট পর্যন্ত আলটিমেটাম Jul 16, 2025
img
অবশেষে শুটিং ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটি ঘোষণা Jul 16, 2025
img
বৃহস্পতিবার ‘জুলাইয়ের গল্প বলা’ অনুষ্ঠান Jul 16, 2025
img
বাহরাইনের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশি দূতের সৌজন্য সাক্ষাৎ Jul 16, 2025
img
ভারতের পুরনো ভিডিও ছড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শনাক্ত: বাংলাফ্যাক্ট Jul 16, 2025
img
চ্যাম্পিয়ন উদযাপনে বিজয়ীদের মেডেল পকেটে ঢুকিয়ে ভাইরাল ট্রাম্প! Jul 16, 2025