ডলারের দরপতন, আস্থা হারাচ্ছে বিশ্ব?

নিরাপত্তার প্রতীক ডলার এখন অনেকটা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত মার্কিন ডলার বিশ্বের প্রধান মুদ্রাগুলোর বিপরীতে নয় শতাংশের বেশি দর হারিয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদকে বিশ্বের সবচেয়ে স্থিতিশীল বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ২৭ ট্রিলিয়ন ডলারের বিশাল ট্রেজারি মার্কেট, বৈশ্বিক বাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য এবং ফেডারেল রিজার্ভের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি এই অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির কারণে সেই বিশ্বাসে এখন চিড় ধরেছে।

ডলার অবশ্য কয়েক মাস ধরেই শক্তি হারাচ্ছে। গত সপ্তাহে বিশ্ববাজারের শেষ কর্মদিবসে (১৮ এপ্রিল) ইউএস ডলার ইনডেক্সের মান ছিল ৯৯ দশমিক ২৩। অথচ জানুয়ারি মাসে এই সূচকের মান ছিল ১১০। সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জানুয়ারি মাসের পর ডলার ইনডেক্সের মান কমেছে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। ১১ এপ্রিল এই সূচকের মান ২০২৩ সালের জুলাই মাসের পর এই প্রথম ১০০-এর নিচে নেমে যায়।

১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার ০ দশমিক ২ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে। তবে সুদের হার বাড়লেও ডলারের পতন প্রমাণ করে, বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাষ্ট্রকে এখন ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন।

ট্রাম্পের বেপরোয়া বাণিজ্যযুদ্ধ এবং শুল্ক বৃদ্ধির কারণে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এবং ভোক্তারা ভোগান্তিতে পড়েছেন। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র মন্দার মুখোমুখি, একই সঙ্গে বাজেট ঘাটতিও ঊর্ধ্বমুখী। দেশটির মোট সরকারি ঋণ জিডিপির প্রায় ১০০ শতাংশ এবং বার্ষিক বাজেট ঘাটতি সাত শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা স্বাভাবিক অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত বেশি।

মার্কিন কংগ্রেস সম্প্রতি এমন একটি বাজেট পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে, যার ফলে আগামী এক দশকে আরও ৫ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের ঘাটতি তৈরি হতে পারে। এটি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের কর ছাড়, এমনকি কোভিড মহামারির সময়ের ব্যয় এবং বাইডেন প্রশাসনের উদ্দীপনা প্যাকেজকেও ছাপিয়ে গেছে।

বিনিয়োগকারীরা এখন প্রশ্ন তুলছেন, ট্রাম্প আসলেই দেশ চালাতে সক্ষম কি না। হঠাৎ করে শুল্ক আরোপ, খাতভিত্তিক ছাড়—সব মিলিয়ে তার নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় স্পষ্টতা ও ধারাবাহিকতা নেই। এমনকি হোয়াইট হাউজের কিছু উপদেষ্টা ডলারকে বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে ধরে রাখার দায়ভার নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন। এই অবস্থায় ফেডারেল রিজার্ভও চাপে পড়েছে। ট্রাম্প সুদের হার কমাতে চাপ দিচ্ছেন। ২০২৬ সালে তিনি নিজের পছন্দমতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান নিয়োগ করতে পারবেন।

বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের হাতে বর্তমানে ৮ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মার্কিন সরকারি বন্ড রয়েছে—এর অর্ধেকেরও বেশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের কাছে, যাদের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব চলে না। আগামী বছরে যুক্তরাষ্ট্রকে নয় ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণ পুনঃঅর্থায়ন করতে হবে। যদি সেই বন্ডের চাহিদা কমে যায়, তাহলে সুদের হার বেড়ে যাবে এবং বাজেট ঘাটতি আরও বাড়বে।

এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস কী করবে? অতীতের অর্থনৈতিক সংকটে তারা বাজেট ব্যয় বাড়িয়ে সমাধান করেছিল। কিন্তু এবার তাদের দ্রুত কর বাড়াতে ও খরচ কমাতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক বিভাজনের বাস্তবতায় তা করা কঠিন হবে। ফলে বাজার থেকে চাপ না এলে নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।

ফেড চাইলেও সহজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। তারা যদি বন্ড কিনে বাজারে স্থিতি আনার চেষ্টা করে, তাহলে সেটি ঋণসংকটে থাকা সরকারের দায় মেটানোর চেষ্টা বলে মনে হতে পারে—যা উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় বিপজ্জনক।

মুদ্রার মান নির্ভর করে যে রাষ্ট্র সেটিকে সমর্থন দেয়, তার ওপর। যদি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল থাকে, ঘাটতির মোকাবিলায় ব্যর্থ হয় এবং নীতি নির্ধারণে পক্ষপাত দেখায়, তাহলে ডলারের ভবিষ্যৎ সংকটে পড়বে।

এসএম/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিএনপির মিছিলে আওয়ামী লীগ নেতার স্লোগান! ভিডিও ভাইরাল Nov 05, 2025
img
বাংলাদেশের দিকে শোষণের দৃষ্টিতে কেউ তাকাতে পারবে না: সারজিস আলম Nov 05, 2025
img
আরপিও সংশোধনী বিএনপির জাতীয় সরকার গঠনে বাধা হবে : মাসুদ কামাল Nov 05, 2025
সব আলোচনাই ব্যর্থ, আন্তর্জাতিক সালিশে আদানির মুখোমুখি হতে চলেছে বাংলাদেশ Nov 05, 2025
গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের টিপিং পয়েন্টে পৃথিবী, সতর্ক করলেন বিজ্ঞানীরা Nov 05, 2025
''প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছর পুরো কাঠামোই বদলে দেবে'' -সাকি Nov 05, 2025
img

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

লুইসের জোড়া গোল, পিএসজিকে ২-১ গোলে হারিয়ে শীর্ষে বায়ার্ন মিউনিখ Nov 05, 2025
শেখ মুজিবুর রহমান ও খালেদা জিয়া'র শাসনামল নিয়ে যে সমালোচনা করলেন নাসীরুদ্দীন Nov 05, 2025
কামাল জামান মোল্লার মনোনয়ন স্থগিত করল বিএনপি Nov 05, 2025
যে পদ্ধতি জানা থাকলে মৃত্যুপথযাত্রীকেও বাঁচানো সম্ভব! Nov 05, 2025
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাবিহীন ফিফপ্রোতে পিএসজি আধিপত্যের ছাপ Nov 05, 2025
পরিপাটি, ফর্সা, গোঁফ-দাড়ি কামানো পুরুষ আমার একেবারেই পছন্দ নয় : মালাইকা Nov 05, 2025
img

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

মিকেল মেরিনোর জোড়া গোলে সহজ জয় আর্সেনালের Nov 05, 2025
img

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

অ্যানফিল্ডে রিয়াল মাদ্রিদকে ১-০ গোলে উড়িয়ে দিল লিভারপুল Nov 05, 2025
img
মার্চ পর্যন্ত সময় পাচ্ছেন নেইমার জুনিয়র, আভাস দিলেন ব্রাজিল কোচ Nov 05, 2025
img
রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২ উইকেটে হারাল পাকিস্তান Nov 05, 2025
img
আমজনতার দলের নিবন্ধন না পাওয়া নিয়ে স্ট্যাটাস রাশেদের Nov 05, 2025
img
মেসির ধারে কাছেও নেই রোনালদো: ফিলিপে লুইস Nov 05, 2025
img
শিগগিরই অবসরের চিন্তা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর, নিতে চান প্রস্তুতি Nov 05, 2025
img
নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়তে কাজ করবো, কিন্তু মাঠে আর থাকছি না: সর্ব মিত্র চাকমা Nov 05, 2025