নোটিশ টানানো 'অফলাইনে বদলি বন্ধ', ভেতরে তদবিরের ভিড়!

'অফলাইনে বদলি' বন্ধ করে দেওয়ার নোটিশ টানানো হয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যার পরও প্রাথমিক বিদ্যালয় অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে দেখা গেছে নানা তদবির নিয়ে বসে থাকতে। সন্ধ্যা সাতটার দিকেও তাঁর কাছে আসছে একের পর এক বদলির তদবির। অথচ অধিদপ্তরের প্রবেশমুখ থেকে শুরু করে ভেতরেও নোটিশ টানানো আছে যে অফলাইনে বদলি বন্ধ। এদিকে এসব বিষয় নিয়ে 'গণমাধ্যমে কথা বলতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নন' বলে জানিয়েছেন ডিজি আবু নূর মো. শামসুজ্জামান।

২২ জুলাই দিনভর অধিদপ্তরে অবস্থান করে মহাপরিচালকের দেখা পাওয়া যায় সন্ধ্যার দিকে। সারাদিন কোথায় ছিলেন তিনি? জবাবে তাঁর কার্যালয় থেকে বারে বারে বলা হয়েছে তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত। মিটিং কোথায় জানতে চাইলে বলা হয়, তিনি মন্ত্রণালয়ে আছেন। প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে কোনো বৈঠক বা ডিজির সেখানে যাওয়ার তথ্য জানা যায়নি। বন্ধ পাওয়া যায় তাঁর দেওয়া সরকারি নম্বর।

এদিকে সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকেরা নানা সমস্যা নিয়ে হাজির। তার একটি বড় অংশ 'তদবির'। হাতে হাতে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় বদলির আবেদন। দেখা গেছে, কেউ যৌক্তিক কারণে বদলি চান। আবার কেউ বদলির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। আবার কাউকে বদলির ক্ষেত্রে বিবেচনা না করে অন্য কাউকে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বদলি করা হচ্ছে—এমন অভিযোগ আসছে একের পর এক।

কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে কোলের শিশু ও কিশোরী মেয়েকে নিয়ে ভোর থেকে মহাপরিচালকের সাক্ষাৎ পেতে একজন শিক্ষিকা অপেক্ষা করছেন। দিনভর দেখা পাননি। যখন মহাপরিচালকের দেখা পাওয়ার মুহূর্ত এলো, তখন সন্ধ্যা। মহাপরিচালকের কক্ষের সামনেই দাঁড়িয়ে জানান, ছোট বাচ্চা নিয়ে সমুদ্র পারাপার হয়ে দীর্ঘ ৮ বছর ধরে কক্সবাজার থেকে মহেশখালীতে গিয়ে স্কুলে ক্লাস নেন। সম্প্রতি কক্সবাজার শহরের স্কুলে পদ খালি হলে তাঁর আবেদন বিবেচনা না করে আরেকজন শিক্ষিকাকে দেওয়া হয়েছে, যাঁর এখানে কোনো স্থায়ী ঠিকানা বা স্বামীর স্থায়ী ঠিকানা নেই।

শিক্ষা অধিদপ্তরের একই রকম একটি 'কেস স্টাডি' খতিয়ে দেখে বাংলাদেশ টাইমস।

২০২১ সালেও একই রকম একটি অনিয়ম হয় সিলেটে। ওই শিক্ষিকা শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়ে রায় নিয়ে আসেন। কিন্তু সেটাও অধিদপ্তর কর্ণপাত করেনি। সম্প্রতি সেটি মন্ত্রণালয়ের নজরে আনা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয় অধিদপ্তরকে। এ নির্দেশের ২০ দিন অতিবাহিত হলেও ফাইল কোন অবস্থায় আছে, সেটি জানা যায়নি। এরকম বদলি সংযুক্তির ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেয় পলিসি বিভাগ। কিন্তু দিনভর পলিসি বিভাগের মহাপরিচালক বা তাদের কর্তাব্যক্তিদের কাউকে কক্ষে পাওয়া যায়নি।



মহাপরিচালক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার কপি হাতে পেয়ে তাঁর পিএসকে ধরিয়ে দেন আগামীকাল মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।

এ সময় তাঁর সামনে আরও বহু আবেদন ও তদবির অপেক্ষা করছে। একে একে তারা সামনে এসে কথা বলছেন। গাজীপুর ট্রাফিক পুলিশের 'ডিসি' পরিচয় দিয়ে একজন তাঁর আত্মীয়ের বদলির বিষয়ে সুপারিশ নিয়ে এসেছেন। এ সময় মহাপরিচালক তাঁকে বলে দিয়েছেন, অফলাইনে বদলি বন্ধ। ডিসেম্বরের দিকে শুরু হলে তখন চেষ্টা করতে হবে। মহাপরিচালকের এমনটা বলার পরও বসেছিলেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। পাশের লেখক পরিচয় দেওয়া আরেকজন তদবিরের অপেক্ষায়। সারাদিন মহাপরিচালক কোনো কিছু না খেয়ে সময় দিচ্ছেন—এমনটা বলে ডিজি'র নজরে আসার চেষ্টা করেন তিনি।

৩০ মিনিট মহাপরিচালকের কক্ষে অবস্থান করে এই চিত্রই দেখা যায়। এরকম নানা আবেদন, বদলি আর তদবির নিয়ে অন্তত ২৫-৩০ জনকে দেখা যায় মহাপরিচালকের কক্ষে।
নাম প্রকাশ না করে একজন বিদ্যালয় শিক্ষিকা জানান, 'বলা হয়েছে অফলাইনে বন্ধ—কিন্তু এটা শুধু পোস্টারে। বাস্তবে অফলাইনে তলে তলে বদলি হচ্ছে।'

আরেকজন শিক্ষিকার প্রশ্ন, তিনি অনলাইনে ঢুকতেই পারেননি। তাহলে কেন বলা হচ্ছে অনলাইনে বদলির আবেদন করতে হবে?

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার মান উন্নয়নে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। উপদেষ্টা সচিবের সঙ্গে মহাপরিচালকও ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার সেই বৈঠকে। প্রধান শিক্ষক নিয়োগ-বদলি সহ বিদ্যালয় ও শিশুদের বিষয় যেসব নির্দেশনা ছিল, তার কতটা পালন করছে অধিদপ্তর? কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে গেল এক সপ্তাহে? এসব প্রশ্নের উত্তরে মহাপরিচালক কথা বলতে একদমই রাজি হননি। মহাপরিচালক সাফ জানিয়ে দেন, তিনি দুঃখিত; গণমাধ্যমে কথা বলার মতো মানসিক পরিস্থিতিতে তিনি নেই। তিনি এও বলেন, তাঁর সাক্ষাৎ পেতে হলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। এ সময় তাঁর সাক্ষাতের বিষয়টি তাঁর দরজায় লেখা রয়েছে জানালে তিনি বলেন, এই সাক্ষাৎ সময়সূচি সাংবাদিকের জন্য নয়।

এ সময় তাঁর কাছে তাঁর সুবিধাজনক সময়ে সাক্ষাৎকার নেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরলে তিনি সেটাও জানাতে পারেননি। তিনি তাঁর পিএসের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। সাক্ষাৎকারের কোনো সময় দেননি পিএস (শিক্ষা অফিসার)।

এদিকে শিক্ষা অধিদপ্তরে দিনের বেলা শুধু মহাপরিচালক অনুপস্থিত নন; সারাদিন কক্ষে দেখা যায়নি পলিসি ও অপারেশন বিভাগের পরিচালককে। মন্ত্রণালয় নির্দেশিত কপি ও বদলি-সংযুক্তির ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেয় এই বিভাগ। কিন্তু তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি অধিদপ্তরে।

(প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের দুর্নীতি, অনিয়ম ও বদলি বাণিজ্য নিয়ে আপনার অভিযোগ বা কোন তথ্য থাকলে জানান। দ্বিতীয় পর্বে প্রকাশিত হবে সেসব)

এফপি/টিএ 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জামালপুরে মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রিক্তা গ্রেপ্তার Sep 18, 2025
img
রাশেদ খানের জন্য সুখবর, হতে পারেন ডাকসুর জিএস Sep 18, 2025
img
পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর Sep 18, 2025
img
বরিশালে সারজিস ও হাসনাতকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা Sep 18, 2025
img
শাহরুখ খানের মতো আর দ্বিতীয় কাউকে পাবে না দর্শক : অনুরাগ কাশ্যপ Sep 18, 2025
img
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাসা ভাড়া না দিতে মাইকিং Sep 18, 2025
img
৫ দফা দাবিতে দেশবাসীকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জামায়াতের Sep 18, 2025
img
বিএনপি সরকার গঠন করলে প্রধানমন্ত্রী হবেন তারেক রহমান: দুদু Sep 18, 2025
img
মরিনহো কি ২ যুগ পর ফের বেনফিকায় ফিরছেন? Sep 18, 2025
img
নির্বাচন হতে দেবে না, এটা ফ্যাসিবাদী মানসিকতা: টুকু Sep 18, 2025
img
ইসরায়েলের ওপর এবার নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব ইইউর Sep 17, 2025
img
অনেক কাজ করেছি যা বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনোদিন হয়নি: আইন উপদেষ্টা Sep 17, 2025
img
ফখর ও আফ্রিদির ব্যাটে ভর করে আমিরাতকে ১৪৭ রানের টার্গেট দিল পাকিস্তান Sep 17, 2025
img
ভারত পৌঁছালো বাংলাদেশি ইলিশের প্রথম চালান Sep 17, 2025
img
প্রেমের টানে ভারত থেকে বাংলাদেশে, ৬ মাস পর ফিরে গেলেন নিজ দেশে Sep 17, 2025
img
আগামী সরকারের মন্ত্রীদের জন্য গাড়ি কেনার অতি আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে টিআইবি Sep 17, 2025
img
টাঙ্গাইলের পলাতক ২ আওয়ামী লীগ নেতা রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার Sep 17, 2025
img
সাদাপাথরকাণ্ডে বিএনপির দুই নেতাকে শোকজ Sep 17, 2025
img
জন্মদিনে মোদির দীর্ঘায়ু কামনা কঙ্গনার Sep 17, 2025
img
ট্রাম্পের বিমানের কাছাকাছি উড়ে যাওয়ায় অন্য বিমানের পাইলটকে ধমক Sep 17, 2025