ভূমিকম্পে যেসব কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়

সাত দশমিক সাত মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে মায়ানমার। ইতিমধ্যে নিহতের সংখ্যা ৭০০ জনে পৌঁছেছে। তবে ভূমিকম্পে মায়ানমারের মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতত্ত্ব জরিপ ও গবেষণা সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস)।

ভূমিকম্প এতটাই শক্তিশালী ছিল যে শত শত মাইল দূরে থাইল্যান্ডেও তা জোরালোভাবে অনুভূত হয়েছে এবং দেশটির রাজধানী ব্যাংককে ভবন ধসে পড়েছে।

এর আগে গত ৭ জানুয়ারি সাত দশমিক এক মাত্রার ভূমিকম্পে হাজারো ঘরবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে যায় তিব্বতে, শতাধিক মানুষের মৃত্যুও হয়।

তবে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় একই মাত্রার ভূমিকম্পে কোনো প্রাণহানি হয়নি, অবকাঠামোগতও তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির মাত্রা কেন বাড়ে সেই প্রশ্ন তৈরি হতেই পারে।
বিশেষজ্ঞরা বেশ কয়েকটি মানদণ্ড বের করেছেন, যেগুলোর কারণে ভূমিকম্পের ফলে ক্ষতি কম বা বেশি হয়।

কম্পনের মাত্রা ও স্থায়িত্বকাল
কম্পনের মাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভূমিকম্পের মাত্রা বোঝাতে যে সংখ্যাটি দেওয়া হয়, তা দিয়ে ফল্ট লাইন কতটুকু সরেছে এবং যে গতি এই সরানোর পেছনে কাজ করেছে, সেটি নির্দেশ করে।
প্রসঙ্গত, পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা

হয় ফল্ট লাইন।
মাটির নিচে দুই দশমিক পাঁচ বা তার কম কম্পন হলে সাধারণত তা অনুভূত হয় না, তবে এটা যন্ত্রে ধরা পড়ে। পাঁচ মাত্রার বেশি কম্পন মানুষ বুঝতে পারে এবং এতে সামান্য ক্ষয়ক্ষতিও হতে পারে।
সাত মাত্রার ওপরের ভূমিকম্পকে বড় কম্পন হিসেবে ধরা হয়। আর আট মাত্রার বেশি ভূমিকম্পকে বিবেচনা করা হয় বড় দুর্বিপাক হিসেবে এবং এটির ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে।
আবার কতক্ষণ ধরে কম্পন হচ্ছে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।

যত বেশি সময় ধরে কম্পন চলবে, ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও তার সঙ্গে বাড়তে পারে।

ভূমিকম্প ও অগ্ন্যুৎপাত সংক্রান্ত বিষয় পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট সিসমিক নেটওয়ার্ক বলছে, কম মাত্রার ভূমিকম্প কেবল কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়। আর মাঝারি থেকে বড় ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে কয়েক মিনিট ধরেও কম্পন চলতে পারে।

গভীরতা
শুধু কম্পনের মাত্রা নয়, মাটির নিচে কোথায় কম্পনটা হলো সেই জায়গাটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০২৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মরোক্কোর পশ্চিমাঞ্চলে ছয় দশমিক আট মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়, সেটার কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠের ১৮ কিলোমিটার নিচে। এভারেস্ট চূড়া যত উঁচু তার চেয়েও বেশি ছিল এই দূরত্ব। কিন্তু ভূতাত্ত্বিক মানদণ্ডে এটা খুব বেশি গভীর নয়। দুই হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি হয় সেখানে।

ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথের ভূতত্ত্ববিদ ড. কারমেন সোলানা বলেন, এই ভূমিকম্পটার কেন্দ্র তুলনামূলক অগভীর ছিল। এর মানে হচ্ছে ভূমিকম্পের শক্তি ও কাঁপন প্রশমিত করার মতো মাটি কম ছিল ওপরে।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে ২০২৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইন্দোনেশিয়ার নর্থ মালাকু প্রদেশে ছয় দশমিক দুই মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়, এর কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠের ১৬৮ কিলোমিটার গভীরে। সেখানে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।

ভূমিকম্পের সময়
মরক্কোয় ভূমিকম্প হয়েছিল রাত ১১টা ১১ মিনিটে। ঘুমন্ত বাসিন্দাদের নিয়ে অনেক ভবন ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ভূতাত্ত্বিকরা একটা কথা বলেন যে ‘ভূমিকম্প নয়, মানুষের প্রাণহানির জন্য দায়ী ভবনগুলো’, যেহেতু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভবন ধসেই মানুষের মৃত্যু হয়। তবে রাতের তুলনায় দিনের বেলার ভূমিকম্পে ক্ষতি কম হয় বলেও মনে করা হয়।

ভবনের অবস্থা
ভূমিকম্প সহনশীল ঘরবাড়ি তৈরি করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মাত্রার কম্পন সহ্য করতে পারে এমন ভবন নির্মাণ করতে হয়। জাপানি স্থপতিরাই এটা সম্ভব করে দেখিয়েছেন।
ইউনিভার্সিটি অব টোকিওর সহযোগী অধ্যাপক ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার জুন সাতো বলেন, ‘কোনো অবকাঠামো যদি ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট শক্তির পুরোটা শোষণ করতে পারে, তখন সেটা ধসে পড়ে না।’

বিষয়টা এমন, ভবন বা অবকাঠামোকে এমন একটা ভিতের ওপর দাঁড় করানো হয়, যেটা ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট শক বা কম্পন সহ্য করতে পারে। ভিতটা বা ভিতের ওই অংশটা ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার পুরু রাবারের ব্লক দিয়ে তৈরি করা হয়। তবে এ রকম ভিত তৈরিতে বেশ ভালো রকম খরচ হয়, ফলে ভবনের নির্মাণব্যয় অনেকটাই বেড়ে যায়।

মরক্কোর যেখানে ভূমিকম্পের আঘাতে ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়েছিল, সেখানে বেশির ভাগ ঘর ছিল পুড়িয়ে বা রোদে শুকানো ইটের তৈরি। ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কে সাত দশমিক আট মাত্রার ভূমিকম্প হয় এবং বলা হচ্ছিল, নীতিমালা মেনে নির্মিত না হওয়ার কারণেই তখন অসংখ্য ভবন ধসে পড়েছিল।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের জরুরি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডেভিড আলেকজান্ডার বলছেন, ‘ভূমিকম্পটা শক্তিশালী ছিল, তবে সঠিকভাবে নির্মিত ভবন ধসিয়ে ফেলার মতো অত বিধ্বংসী ক্ষমতার ছিল না। বরং অনেক এলাকায়ই কম্পন সর্বোচ্চ মাত্রার চেয়ে কম ছিল। ফলে আমরা বলতেই পারি, ধসে পড়া হাজার হাজার ভবনের কোনোটিই সঠিক নীতিমালা মেনে নির্মিত হয়নি।’

জনসংখ্যার ঘনত্ব
২০২১ সালের জুলাইয়ে আলাস্কা উপত্যকায় আট দশমিক দুই মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল এবং এটা খুবই সম্ভব যে ওই ঘটনার স্মৃতি অনেকেরই মনে নেই। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে এটাকে রাখা হয়েছে সাত নম্বরে।

ওই ভূমিকম্পে কেউ মারা যায়নি, কোনো ক্ষয়ক্ষতিও হয়নি। এর কারণ ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল জনবসতি থেকে অনেক দূরে। সেই তুলনায় ২০১০ সালের জানুয়ারিতে হাইতিতে সাত মাত্রার ভূমিকম্পে আড়াই লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ও অন্তত তিন লাখ মানুষ আহত হন। আশ্রয় হারান ১৫ লাখের বেশি মানুষ। দেশটির রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সে প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল ২৭ হাজার জনের ওপরে এবং ভূমিকম্পের মূল ধাক্কাটাই লেগেছিল ওই শহরে।

মাটির ধরন
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের ওপরের মাটির প্রকৃতি কী বা মাটি কতটা শক্ত তার ওপরও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্ভর করে।

ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে বা ইউএসজিএসের মতে, ভূপৃষ্ঠে বা এর কাছাকাছি স্তরে কাদামাটি থাকলে শক্তিশালী কম্পন সহ্য করতে পারে না সেটি। এ ক্ষেত্রে কম্পন শুরু করে মাটির ওপরের স্তরটি তরল পদার্থের মতো টালমাটাল আচরণ শুরু করে এবং ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়।

১৯৬৪ সালে জাপানের নিগাতয় ভূমিকম্পে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। এদিকে ২০২৩ সালে তুরস্কের যেখানটায় ভূমিকম্পে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, তার মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে এরজিন শহরে কোনো আঁচড়ও পড়েনি। সেখানে কোনো প্রাণহানি বা ভবনধস হয়নি। অথচ আশপাশের প্রায় সব শহর ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, শক্ত ও পাথুরে ভূপৃষ্ঠের কারণেই এরজিন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

এফপি/এস এন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
দুর্ঘটনার শিকার ওয়েলস নারী ফুটবল দল Jul 09, 2025
প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের সামনে 'মাননীয়' কথাটা কি বাদ দিতে পারি না: মির্জা ফখরুল Jul 09, 2025
img
‘মারেম্মা’ অ্যাকশন সিনেমা দিয়েই বড়পর্দায় অভিষেক রবি তেজার ভাইপো মাধবের! Jul 09, 2025
img
গণতন্ত্রের জন্য চায়না বা ওয়েস্টের দিকে তাকিয়ে লাভ নাই : মোশারফ আহমেদ ঠাকুর Jul 09, 2025
img
৯ জুলাই ২০২৪: দেশজুড়ে সকাল-সন্ধ্যা চলে ‘বাংলা ব্লকেড’ Jul 09, 2025
img
মুক্তির আগেই বিতর্কে পাওয়ান কল্যাণের নতুন ছবি ‘হরি হরা বীর মাল্লু’! Jul 09, 2025
টাকা না পেয়ে জুলাই ফাউন্ডেশনের অফিস ভাঙচুর করলেন আহতরা Jul 09, 2025
img
শ্রীলঙ্কায় সিরিজ ব্যর্থতায় মিরাজের আক্ষেপ Jul 09, 2025
img
পুতিনের ওপর আমি খুশি নই : ট্রাম্প Jul 09, 2025
img
নির্বাচনে বেশির ভাগ মানুষ ভোটই দিতে যাবে না : মাসুদ কামাল Jul 09, 2025
img
টেক্সাসে আকস্মিক ভয়াবহ বন্যা, নিখোঁজ শত শত লোক Jul 09, 2025
img
বৃষ্টি আর জ্যাম মিলেমিশে একাকার: ইমন Jul 09, 2025
img
বিক্ষোভ দমনে শেখ হাসিনার নির্দেশেই গুলি? বিবিসির অনুসন্ধানে উঠে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য Jul 09, 2025
img
ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা আমার নেই : উপদেষ্টা সাখাওয়াত Jul 09, 2025
img
দেশে কত দামে স্বর্ণ ও রুপা বিক্রি হচ্ছে আজ? Jul 09, 2025
img
শহীদদের কোনো দলের কর্মী বানাতে চাই না: ডা. জাহিদ হোসেন Jul 09, 2025
img
উত্তর কোরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল যুক্তরাষ্ট্র Jul 09, 2025
img
নোয়াখালীতে ২৪ ঘণ্টায় ২০৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের রেকর্ড Jul 09, 2025
img
নরসিংদীতে কারখানা লুটপাটের ঘটনায় যুবদল নেতা বহিষ্কার Jul 09, 2025
img
হাওরের মানুষের সুরক্ষায় ভাসমান হাসপাতাল স্থাপন করা হবে : রিজওয়ানা হাসান Jul 09, 2025