প্যান-ইন্ডিয়া ব্লকবাস্টারের যুগে, বড় গল্প আর মারকাটারি চিত্রনাট্যে ঈশ্বর হয়ে উঠেছেন অন্যতম লাভজনক ‘তারকা’। এমনকি নামের শুরুতে না থেকেও, চরিত্রের গভীরে বা গল্পের আবহে ঈশ্বরসুলভ উপস্থিতি দিয়েই সিনেমাগুলো দখল করে নিচ্ছে বক্স অফিস। ‘আরআরআর’ থেকে ‘কান্তারা’, ‘পুষ্পা’ থেকে আসন্ন ‘মহাভারত’, প্রত্যেকটিতেই ধর্মীয় আভা ছড়ানো এক ধরনের চরিত্র বা প্রতীক ব্যবহার করা হচ্ছে, যা নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন।
এই প্রবণতা কি স্রেফ নির্মাতাদের সৃষ্টিশীল স্বাধীনতা? নাকি দর্শকের বিশ্বাসকে বিক্রি করার এক সুচিন্তিত কৌশল? এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে সমালোচক মহলেও।
বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে, বহু ছবিতে ঈশ্বরের নাম বা প্রতীক ব্যবহার হচ্ছে নায়ক তৈরির শর্টকাট হিসেবে। এদের অনেকেই বাস্তব ধর্মীয় গ্রন্থভিত্তিক না হলেও, উপস্থাপন করা হচ্ছে আধুনিক, অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন এক ‘অল-পাওয়ারফুল’ রূপে। যিনি হঠাৎ করে দয়ালু হয়ে পড়েন এমনকি নৈতিকভাবে বিভ্রান্ত মূল চরিত্রগুলোর প্রতিও। অনেক সময় এই ঈশ্বরসুলভ চরিত্রগুলো দেখা যাচ্ছে অ্যান্টি-হিরোদের পাশে দাঁড়াতে, যা আরও বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।
যেমন ‘আরআরআর’ ছবিতে রামচরণ অভিনীত চরিত্রটি সরাসরি কোনও ধর্মীয় প্রতীক নয়, কিন্তু তাঁর প্রতিটি কাজ ও উপস্থিতি ভগবান রামের ন্যায়-নীতি অনুসরণ করছে বলে তুলে ধরা হয়েছে। এই ধরনের উপস্থাপনাকে অনেকেই বলছেন ‘স্মার্ট ব্যাখ্যা’, আবার কেউ কেউ এটিকে দেখছেন বিশ্বাসকে বানিজ্যিকভাবে ব্যবহার করার এক মোক্ষম পন্থা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক দর্শক প্রশ্ন তুলেছেন, “নৈতিকভাবে বিভ্রান্ত বা সহিংস চরিত্রের পাশে কেন ঈশ্বর থাকবেন?” জবাবে নির্মাতারা জানাচ্ছেন, “সিনেমা একটি ব্যাখ্যামূলক মাধ্যম। আমরা প্রতীকী ভাষায় গল্প বলছি।” তবে দর্শকদের আপত্তি ঈশ্বর দেখানো নিয়ে নয়, আপত্তি তখনই, যখন ঈশ্বরকে ব্যবহার করা হয় গল্পের গভীরতা তৈরি না করে কেবল নাটকীয় মোড় আনার জন্য।
ধর্মীয় আবহ আর আবেগে গাঁথা ‘কান্তারা’-র ক্লাইম্যাক্স দৃশ্য দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায় ঠিকই, কারণ সেখানে ছিল আবেগ, বিশ্বাস ও গল্পের ভারসাম্য। কিন্তু এমন অনেক চলচ্চিত্রেও দেখা যায়, ঈশ্বরের আবির্ভাব কেবল ‘পাওয়ার আপ’-এর মতো, যেন ভিডিও গেমে শেষ মুহূর্তে চরিত্রকে শক্তি দেওয়া হচ্ছে। তখন দর্শক নিজেকে প্রতারিত বোধ করেন।
এই প্রবণতা প্রমাণ করে, ভারতীয় সিনেমায় ঈশ্বরের উপস্থিতি নতুন কিছু নয়। বরং নতুন হলো, সেই উপস্থিতির মানে ও দায়িত্ববোধ। নির্মাতাদের তাই ভাবতে হবে, তাঁরা কি সত্যিই গভীর গল্প বলছেন, না কেবলমাত্র বিশ্বাসকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন?
কারণ যেখানে আস্থা এত গভীরভাবে প্রোথিত, সেখানে ঈশ্বরকে ‘প্লট হ্যাক’ বানিয়ে তোলা মানে এক বিপজ্জনক খেলা, যা শেষ পর্যন্ত দর্শকের আস্থা ও ভাবনার জায়গাটাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এমআর/টিকে