‘শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডের’ চিত্র তুলে ধরলেন প্রেস সচিব

২০১৩ সালের ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ খুলেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, যুবলীগ–ছাত্রলীগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আক্রমণ, ভয় দেখানো ও হত্যা- আওয়ামী লীগ সরকার একই কৌশলই বারবার ব্যবহার করেছে। অবশেষে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে তারা পুরো জাতির প্রতিরোধের মুখে পড়ে।

আজ সোমবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজ থেকে দেওয়া এক দীর্ঘ পোস্টে প্রেস সচিব এসব কথা বলেন।

তার পোস্টটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
‘‘শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড’ বলতে সাধারণত মতিঝিলের শাপলা স্কয়ার এলাকাকে কেন্দ্র করে হওয়া হত্যাকাণ্ডকেই বোঝানো হয়। ৫ মে রাতেই শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড থেকে প্রথম দফায় হতাহতের খবর আসতে শুরু করে। পল্টন, বিজয়নগর, নাইটিঙ্গেল মোড় এবং মতিঝিলের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হচ্ছিল। ২০১৩ সালে এএফপি’র ঢাকা অফিস ছিল তৎকালীন শিল্প ব্যাংক (বর্তমান বিডিবিএল ভবন), দিলকুশা–মতিঝিলে। আমাদের জানালা থেকে দেখা যাচ্ছিল, শাপলা চত্বরে এবং মতিঝিলের মূল সড়কজুড়ে কয়েক দশক হাজার হেফাজত সমর্থকের ভিড়। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক-দুটি লাশ শাপলা চত্বরে আনা হলো। আমরা জানতাম না তারা কোথায় বা কীভাবে মারা গেছে। 

রাত আটটার দিকে আমরা প্রথম বড় তথ্যটি পাই: শাহিদবাগ–মালিবাগের বারাকা জেনারেল হাসপাতালে হেফাজত সমর্থকের ছয়টি লাশ নেওয়া হয়েছে- প্রতিটি লাশের মাথায় গুলি করা।

আমার সহকর্মী কামরুল তথ্যটি যাচাই করতে হাসপাতালটিতে অন্তত এক ডজন ফোন করেন। বহুবার চেষ্টা করার পর হাসপাতালের ম্যানেজার মৃত্যুর ঘটনাটি নিশ্চিত করেন। আমি খবরটি রেড-অ্যালার্ট হেডলাইন হিসেবে ছাপাতে চাইছিলাম, কিন্তু নিউ দিল্লির আমাদের ব্রিটিশ সম্পাদক জোর দিলেন- আরেকটি উৎস থেকে নিশ্চয়তা পাওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয় উৎস নিশ্চিত করার পর আমাদের মৃত্যুর সংখ্যা স্থানীয় কোনো পত্রিকা বা টিভি স্টেশনের রিপোর্ট করা সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায়।

পরদিন আমরা কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে আরও লাশের তথ্য নিশ্চিত করি। সংখ্যা বাড়তেই থাকল। এরপর খবর আসে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর–সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় একটি বড় হত্যাকাণ্ডের। ভোরে পুলিশ তাড়ানোর পর হেফাজতের একটি বড় দল পরিবহন বন্ধ থাকায় হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। আমরা জানতে পারি, বিডিজি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সদস্যরা তাদের ওপর গুলি চালায় এবং প্রায় ২০ জনকে হত্যা করে। নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি হাসপাতালে আমরা লাশগুলো খুঁজতে যাই। পুলিশ ও বিডিজি কোনো তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়, কিন্তু হাসপাতালের কর্মীরা মৃত্যুর ঘটনা নিশ্চিত করেন। 

ঢাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, আইজিপি এবং ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করলেন যে পুলিশ কাউকে হত্যা করেছে। তারা আন্দোলন প্রতিরোধকে নিজেদের ‘দেশকে তালেবান রাষ্ট্র হওয়া থেকে রক্ষা করার’ জয় হিসেবে প্রচার করতে লাগল এবং দাবি করল যে অভিযানে খুব সামান্য হতাহত হয়েছে। কিন্তু আমাদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তেই থাকে। পুলিশ যখন এখনো সাতজন মৃত্যুর কথা বলছে, তখন আমাদের হিসাব ৪৯-এ পৌঁছে গেছে। আমরা জানতাম কর্তৃপক্ষ আমাদের রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ করবে। তাই বাধ্য হয়ে প্রতিটি মৃত্যুর উৎস উল্লেখ করতে হয়- এটি আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ালেও রিপোর্টটিকে ভারী ও জটিল করে তোলে।

পরে অধিকার সংগঠন মৃতের সংখ্যা প্রায় ৬০ বলে অনুমান করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচও তদন্ত করে একই রকম সংখ্যা পায়। পরে আমি আরেকটি ব্যাপার জানতে পারি- পল্টন ও ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকায় অনেক হত্যাকাণ্ডই করেছে অস্ত্রধারী যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা। তাদের মধ্যে দুজনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম: জাহিদ সিদ্দিকী তারেক ও রিয়াজ মিল্কি।

করুণ পরিণতিতে তারেক পরবর্তীতে মিল্কিকে এক মার্কেটের সামনে গুলি করে হত্যা করে- ঘটনাটি সিসিটিভিতে ধরা পড়ে। পরে তারেককে র্যাব খুঁজে বের করে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মেরে ফেলে।
এরপরের এগারো বছর ধরে—আওয়ামী লীগ একই কৌশলই বারবার ব্যবহার করেছে: যুবলীগ- ছাত্রলীগকে লাগিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আক্রমণ, ভয় দেখানো ও হত্যা। অবশেষে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে তারা পুরো জাতির প্রতিরোধের মুখে পড়ে।’

কেএন/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
দেশ রক্ষার জন্য যুদ্ধে নামতে হবে, নয়তো দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে: তারেক রহমান Dec 10, 2025
img
৬ ঘণ্টা অবরুদ্ধ অর্থ উপদেষ্টা, এবার কঠোর অবস্থানে পুলিশ Dec 10, 2025
img
ভারতে পা দিয়েই কপিল শর্মার উদ্দেশে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার কড়ার্বাতা Dec 10, 2025
img
পদত্যাগের পর আসিফ-মাহফুজকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ পরামর্শ Dec 10, 2025
img
অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ব্রাকসু নির্বাচন Dec 10, 2025
img
সরকারি প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের বেতন ১১তম থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীত Dec 10, 2025
img
প্লাস্টিক সার্জারি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করলেন কেট উইন্সলেট Dec 10, 2025
img
‘উপদেষ্টা আসিফ জোর করেই আমাকে কুমিল্লার দায়িত্ব দিয়েছেন’ Dec 10, 2025
img
ব্যারিষ্টার ফুয়াদের বিরুদ্ধে নিজ এলাকায় ঝাড়ু মিছিল Dec 10, 2025
img
জানুয়ারি থেকে সরকারি বাসভবন গ্রেসি ম্যানসনে থাকবেন মামদানি Dec 10, 2025
img
ফের আফগানিস্তানে ভূমিকম্পের আঘাত Dec 10, 2025
img
মাংসের চেয়ে আলু বেশি, অনিয়ম ধরে ফেললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Dec 10, 2025
img
রাজধানীর কুড়িলে মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীদের সড়ক অবরোধ Dec 10, 2025
img
তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ কার্যকর হবে: প্রেস সচিব Dec 10, 2025
img
১৩ বছর অপেক্ষার পর কলকাতায় এআর রহমানের লাইভ শো Dec 10, 2025
img
প্রধান বিচারপতির সঙ্গে জার্মান রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ Dec 10, 2025
img
৮৮ মিনিটেও রাহুলের মন গলাতে পারলেন না মোদি Dec 10, 2025
img
‘ধুরন্ধর’ নিয়ে উঠল নারীবিদ্বেষের অভিযোগ, অভিনেত্রীর বক্তব্যে মনে পড়ছে ‘অ্যানিম্যাল’? Dec 10, 2025
img
দেশকে স্বনির্ভর করতে রাজস্ব দিন : চসিক মেয়র Dec 10, 2025
img
ধানের শীষকে জেতানোর বিকল্প নেই: তারেক রহমান Dec 10, 2025