বিদেশে বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ ৪ নেতার বৈঠক, যা বলছেন দল দুটির নেতারা

বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সাক্ষাৎ ও বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এই বৈঠক এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হলো যখন বাংলাদেশে দুই দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী অবস্থান ও পাল্টাপাল্টি কথার লড়াই দেখা যাচ্ছে।

রবিবার যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

চিকিৎসার জন্য চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে লন্ডনে অবস্থান করছেন খালেদা জিয়া।

আর এক-এগারোর পটপরিবর্তনের সময় থেকেই সেখানে রয়েছেন তারেক রহমান। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বেলজিয়াম সফরে যান জামায়াতের আমির ও নায়েবে আমির। সেখান থেকে লন্ডনে যান তারা।
জামায়াতে ইসলামীর তরফে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নেওয়ার উদ্দেশ্যেই দেখা করেছেন তারা।

দলটির মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে আগামীতে দুই দলের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে।

মতিউর রহমান আকন্দ সম্পর্ক ‘দৃঢ়’ করার প্রত্যাশা জানালেও, একসময়ের জোটসঙ্গী দুই দলের সম্পর্কে বেশ কিছুদিন ধরে বিরোধিতা, সমালোচনা ও বিতর্কই বেশি দৃশ্যমান হয়েছে। ৫ অগাস্টের পর থেকে সংস্কার, নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধের মতো ইস্যুগুলোতে স্পষ্ট হয়েছে পরস্পরের মতভেদ। এমন প্রেক্ষাপটে দুই দলের শীর্ষ নেতাদের সাক্ষাৎ রাজনীতির অঙ্গনে কৌতূহল তৈরি করেছে।

জামায়াতে ইসলামীর শফিকুর রহমানকে উদ্ধৃত করে একটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীর স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেওয়ার ‘নৈতিক দায়িত্ব’ পালন করেছেন তারা। জামায়াত আমির ওই সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে অনেক দিন কাজ করেছি। উনি অসুস্থ। ওনার খোঁজখবর নেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। বহুদিন পর আমাদের দেখা হয়েছে।

আমরা ওনার জন্য দোয়া করেছি, ওনার কাছে দোয়া চেয়েছি।’ তারেক রহমানের সঙ্গেও অনেক কথা হয়েছে জানালেও শফিকুর রহমান বিস্তারিত কিছু বলেননি সংবাদমাধ্যমটিকে।

বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কিছু বলতে চায়নি। তবে দলটির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা জানান, এটিকে একটি সৌজন্য সাক্ষাৎ হিসেবেই দেখছেন তারা। এর কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে কি না, সে ব্যাপারে কিছু বলতে চাননি তিনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, এটা তাদের মধ্যে মত পার্থক্য কমিয়ে আনার একটা চেষ্টা হতে পারে। তেমন চেষ্টা হয়ে থাকলে কয়েক দিন পরে এর প্রভাব বোঝা যাবে।

তিনি বলেন, ‘দেখতে হবে কয়েক দিন পরে তারা পরস্পরের প্রতি বিষোদগার করছে কি না, যদি বিষোদগার কমে আসে তাহলে বুঝতে হবে এই সাক্ষাৎ ও বৈঠক একটা ভূমিকা রেখেছে।’

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ৫ অগাস্টের পর থেকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। বিএনপির সঙ্গে তার এক সময়ের মিত্র জামায়াতের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছিল কয়েক বছর ধরে। তার মধ্যেও আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে দুই দলকেই ব্যাপকভাবে সক্রিয় দেখা গেছে।

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর রাজনীতিতে আওয়ামী লীগবিহীন মাঠে দল দুটির পুরনো টানাপড়েন ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে। বৈরিতার উপলক্ষ্য হয়ে ওঠে চলমান নানা ইস্যু।
ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দোষারোপ শুরু হয়। সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে– এই প্রশ্নে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়ে বিবাদে জড়ায় বিএনপি-জামায়াত।

নির্বাচনের সময় নিয়ে একে অপরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস থেকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পাল্টাপাল্টি বক্তৃতা-বিবৃতি বাড়তে থাকে। গণ-অভ্যুত্থানে কৃতিত্ব নিয়েও পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেয় দল দুটি।

এমনকি জামায়াত নিজেদের ‘পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক শক্তি’ দাবি করার পর বিএনপিকে জামায়াতের দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন তুলতে দেখা গেছে। এসব বিতর্ক বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি শীর্ষ নেতারাও কখনো কখনো অংশ নিয়েছেন।

দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ যখন প্রথম ক্ষমতায় আসে তখন থেকেই আওয়ামী লীগের সাথে বেশ বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় জামায়াতের। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়, বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির সাথে ১৯৯৯ সালে জোট বাধে জামায়াতে ইসলাম।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসার পর থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে দল দুটির মধ্যে কিছু টানাপড়েন তৈরি হলেও জোট নিয়ে কোনো ধরনের সংকট তৈরি হয়নি।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একসাথে অংশ নেয় দল দুটি। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একটানা সাড়ে ১৫ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারের মুখোমুখি করেছে।

যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াতের শুধু নয় বিএনপিরও এক নেতার ফাঁসি হয়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার আগ পর্যন্ত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াও সাজাপ্রাপ্ত হয়ে গৃহবন্দি ছিলেন।
এই সময় জামায়াত-বিএনপির মধ্যে নানা সংকট হলেও রাজনৈতিক জোট ছিল দুই বছর আগ পর্যন্ত। এমনকি নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনেও জামায়াতের প্রার্থীরা ভোটে অংশ নিয়েছিল বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে।

২০২২ সালে দুই দল আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ভেঙে দিয়ে সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলনে শুরু করে। কিন্তু ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার এক মাসের মাথায় নানা ইস্যুতে দল দুটির মতবিরোধ রাজনীতির মাঠে আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জয়পুরহাটে নার্সিং ইনস্টিটিউটে আগুন Jul 16, 2025
img
লর্ডসে হার সত্ত্বেও মন ছুঁয়েছেন সিরাজ, হতাশা কাটিয়ে দিলেন প্রথম প্রতিক্রিয়া Jul 16, 2025
img
যশোরে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ১৪ পরিবারকে সেনাবাহিনীর সহায়তা Jul 16, 2025
img
শামিকে ছাঁটাইয়ের পথে হায়দরাবাদের নতুন বোলিং কোচ Jul 16, 2025
img
অতীতে কোনো কোনো দেশ একটি রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক রেখেছিল: জামায়াত আমীর Jul 16, 2025
img
কন্যা সন্তানের বাবা-মা হলেন সিদ্ধার্থ-কিয়ারা Jul 16, 2025
বরিশালে এনসিপির পদযাত্রা Jul 16, 2025
img
বাংলাদেশকে চাঁদাবাজ-দুর্নীতিমুক্ত করেই আমরা ঘরে ফিরব : নাহিদ ইসলাম Jul 16, 2025
img
জুলাইয়ের চেতনা ধারণ করে একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার Jul 16, 2025
img
মহেশপুর সীমান্তে ৭ বাংলাদেশিকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর বিএসএফের Jul 15, 2025
img
কুমিল্লার চান্দিনা পৌরসভার সাবেক মেয়র গ্রেফতার Jul 15, 2025
img
জিয়া পরিবার ক্ষমতায় এলে দেশ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে : সরওয়ার জামাল Jul 15, 2025
img
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ঢাবি উপাচার্যের সাক্ষাৎ Jul 15, 2025
img
দীর্ঘ ৮ বছর পর টেস্ট দলে ফিরলেন ইংল্যান্ডের অলরাউন্ডার Jul 15, 2025
img
সিরিজের শেষ ম্যাচে উইনিং কম্বিনেশন ভাঙার ইঙ্গিত দিলেন সালাউদ্দিন Jul 15, 2025
img
‘সিআইডি’ তারকাদের পারিশ্রমিক, কে কত পান! Jul 15, 2025
img
ফের প্রেমের গুঞ্জনে হাওয়া দিলেন কৃতি স্যানন! Jul 15, 2025
img
৪৩ ছুঁই ছুঁই অ্যান্ডারসন দল পেলেন দ্য হান্ড্রেডে Jul 15, 2025
৪ হাজার কোটির রামায়ণ, ভারতীয় সিনেমায় নতুন মাইলফলক Jul 15, 2025
বিপিএলে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগোতে চাই: মাহবুব আনাম Jul 15, 2025