সুদানে অপুষ্টিতে এক সপ্তাহে প্রাণ গেল ৬৩ জনের

সুদানের পশ্চিমাঞ্চলের অবরুদ্ধ শহর এল-ফাশেরে গত এক সপ্তাহে অন্তত ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে অপুষ্টিতে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।রবিবার (স্থানীয় সময়) উত্তর দারফুর প্রদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।

এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, কোনোভাবে হাসপাতালে পৌঁছাতে পেরেছেন শুধু তাদের মৃত্যুর সংখ্যা এখানে হিসাব করা হয়েছে। বাস্তবে আরো অনেক পরিবার নিরাপত্তাহীনতা ও যানবাহনের অভাবে চিকিৎসা নিতে না পেরে ঘরে বা স্থানীয়ভাবে প্রিয়জনদের দাফন করেছেন।

গত বছরের মে মাস থেকে এল-ফাশের শহরটি আধাসামরিক বাহিনী ‘র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’ (আরএসএফ)-এর অবরোধে রয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া যুদ্ধে আরএসএফ সুদানের সরকারি সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

এল-ফাশেরে বর্তমানে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা দারফুরের শেষ বড় শহর হিসেবে টিকে আছে। তবে চলতি বছর শুরুর দিকে রাজধানী খার্তুম থেকে সরে আসার পর আরএসএফ নতুন করে এই শহরে হামলা জোরদার করেছে।

গত এপ্রিলে নিকটবর্তী জামজাম বাস্তুচ্যুত শিবিরে আরএসএফের বড় ধরনের আক্রমণের পর হাজারো মানুষ পালিয়ে এসে এল-ফাশেরে আশ্রয় নেয়। একসময় যেসব ‘কমিউনিটি কিচেন’ বাস্তুচ্যুতদের জন্য প্রধান খাদ্য সহায়তা ছিল, সেগুলোর বেশিরভাগই এখন বন্ধ হয়ে গেছে খাদ্য সংকটের কারণে। অনেক পরিবার পশুখাদ্য বা পচা খাবারের ওপর নির্ভর করছে।

শহরের সবচেয়ে বড় কমিউনিটি কিচেনে প্রতিদিন সকালে প্রায় ১ হাজার ৭০০ মানুষকে সুদানের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘আসিদা’ দিচ্ছে।
কিন্তু পরিমাণ খুবই কম।

রান্নাঘরের ব্যবস্থাপক মাজদি ইউসুফ বলেন, ‘ছয় মাস আগে আমরা দিনে দুই বেলা খাবার দিতাম, এখন বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় দিনে মাত্র একবার খাবার দিতে পারছি।’ আগে একটি প্লেট তিনজন ভাগ করে খেত, এখন সেই একই প্লেট সাতজনের মধ্যে ভাগ করতে হয়।

ইউসুফ জানান, প্রতিদিন নারী ও শিশুদের ফুলে ওঠা পেট ও গভীর ডোবা চোখ নিয়ে খাবারের লাইনে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে, যা মারাত্মক অপুষ্টির লক্ষণ। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এল-ফাশেরে পাঁচ বছরের নিচে প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।

যার মধ্যে ১১ শতাংশ ভুগছে মারাত্মক তীব্র অপুষ্টিতে।

এক বছর আগে এল-ফাশেরের আশপাশের বাস্তুচ্যুত শিবিরগুলোতে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল। জাতিসংঘ বলেছিল, গত মে মাস নাগাদ এই দুর্ভিক্ষ শহরের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়বে। তবে সঠিক তথ্য না থাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে শহরে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা সম্ভব হয়নি।

জাতিসংঘ বারবার সতর্ক করে বলছে, এল-ফাশেরে ও আশপাশের শিবিরগুলোতে প্রায় দশ লাখ মানুষ কার্যত সাহায্য ও মৌলিক সেবার বাইরে আটকা পড়ে আছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলেছে, শহরের হাজার হাজার পরিবার এখন ‘মৃত্যুকূপে পতিত হওয়ার ঝুঁকিতে’ রয়েছে।

গত জুনে এল-ফাশেরগামী জাতিসংঘের ত্রাণবাহী বহরে হামলায় পাঁচজন সহায়ক কর্মী নিহত হন। এর ওপর বর্ষাকাল—যা আগস্টে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবে—সাহায্য পৌঁছানোকে আরো কঠিন করে তুলছে। রাস্তা দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ফলে সরবরাহ কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তৃতীয় বছরে গড়ানো এই যুদ্ধে সুদানে এখন পর্যন্ত লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।

জাতিসংঘ বলছে, এটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাস্তুচ্যুতি ও ক্ষুধা সংকট। ইউসুফ বলেন, ‘যারা কমিউনিটি কিচেনে খাচ্ছেন তারাও আসলে না খেয়ে আছেন।’

তিনি জানান, শিশুদের চোখে তিনি স্পষ্ট খাদ্য সংকটের ভয় দেখতে পান। এল-ফাশেরের একটি শিশু হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, সম্প্রতি মারাত্মক অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের ভিড় হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ রোগী গুরুতরভাবে অপুষ্ট, আর চিকিৎসা সরঞ্জাম মারাত্মকভাবে কমে গেছে।’

দুর্ভিক্ষকবলিত নিকটবর্তী আবু শৌক শিবিরের সম্প্রদায় নেতা আদম ইসা জানান, তিনি সম্প্রতি পাঁচ শিশুর দাফন করে এসেছেন। তার ভাষায়, শিবিরটিতে প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাতজন শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সুদান প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, ‘আমরা এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি। আমরা একটি প্রজন্মের শিশুদের স্থায়ী ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছি।’

সূত্র : আল-অ্যারাবিয়া।

এমআর/টিকে  

Share this news on:

সর্বশেষ

img
দিল্লিতে বসে হাসিনার অপরাজনীতি চলবে না : রাশেদ প্রধান Oct 10, 2025
img
থালাপতি বিজয়ের বাড়িতে বোমার খবরে এলাহি কাণ্ড Oct 10, 2025
দেশপ্রেম শুধু মঞ্চে, কাজে দলই বড় - প্রশ্ন তুলল জামায়াত Oct 10, 2025
img
মুক্তি পেয়ে তুরস্কে পৌঁছেছেন শহিদুল আলম Oct 10, 2025
img
শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আর নেই Oct 10, 2025
img
গাজায় দৈনিক ৬০০ ত্রাণ ট্রাক প্রবেশের অনুমতির সিদ্ধান্ত ইসরায়েলের Oct 10, 2025
img
মোহাম্মদপুরে ঝটিকা মিছিলের চেষ্টা, ২ আটক Oct 10, 2025
img

এরদোয়ানকে প্রধান উপদেষ্টার ধন্যবাদ

ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন শহিদুল আলম Oct 10, 2025
img
দুঃখ ভুলতে গানের জগতে পা রাখেন জন লেনন Oct 10, 2025
img
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কে এই মারিয়া করিনা মাচাদো? Oct 10, 2025
img
আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, স্পেন এরপর ব্রাজিল Oct 10, 2025
img
ডিএমপির ঊর্ধ্বতন ৮ কর্মকর্তাকে রদবদল Oct 10, 2025
img
শান্তিতে নোবেল পেয়ে ‘অবাক’ মারিয়া কোরিনা Oct 10, 2025
img
শাহজালালে ৬৫ ভরি স্বর্ণসহ আটক ২ Oct 10, 2025
img
ঐশ্বরিয়ার জন্যই ‘দেবদাস’ থেকে বাদ পড়েন সালমান? Oct 10, 2025
img
হাতিরঝিলে বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ৯ Oct 10, 2025
img
‘অবৈধ অনুপ্রবেশে’ ভারতে আটক ৩৪ বাংলাদেশি নাগরিক Oct 10, 2025
img
‘না বলা’ অনেক কথা বলবেন নোবেল Oct 10, 2025
img
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সুখবর দিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম Oct 10, 2025
img
আগে গণভোট পরে সংসদ নির্বাচন, দাবি খেলাফত মজলিসের Oct 10, 2025