প্রকৃতি কন্যা জাফলং

বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সবুজ বন ও বাগানের সৌন্দর্য ঘেরা একটি পাহাড়ি অঞ্চলের নাম জাফলং। এখানে পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন বলে এই এলাকা বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটনস্থল হিসেবে পরিচিত। সিলেট নগরী থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত জাফলং।

জাফলং সিলেট বিভাগের একটি হিল স্টেশন এবং অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। পাথর সংগ্রহ করা এবং আদিবাসী খাসিয়া সম্প্রদায়ের বসবাস এই দুটি কারণে জাফলং এর খ্যাতি রয়েছে।

জাফলংয়ের ধলাই ও পিয়াইনের স্বচ্ছ জলে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় নানা জাতের ছোট মাছ। দুই নদীর পানির নিচ থেকে ডুব দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিকের পাথর উত্তোলনের দৃশ্যও মুগ্ধ করে পর্যটকদের। নদীর পানিতে নারী-পুরুষের এই ‘ডুবোখেলা’ দেখা যায় ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি। সীমান্তের ওপারে ডাউকি নদীর উপরে দুই পাহাড়ের মধ্যখানে ঝুলন্ত সেতু বাড়িয়ে তুলেছে জাফলংয়ের সৌন্দর্য। পাহাড়, পানি, পান, পাথর, ঝর্ণা সবমিলিয়ে জাফলং যেন এক রূপকথার রাজ্য।

জাফলংয়ে শীত ও বর্ষা মওসুমের সৌন্দর্যের রূপ ভিন্ন। বর্ষায় জাফলংয়ের রূপ লাবণ্য যেন ভিন্ন মাত্রায় ফুটে উঠে। ধূলি ধূসরিত পরিবেশ হয়ে উঠে স্বচ্ছ। স্নিগ্ধ পরিবেশে শ্বাস-নিঃশ্বাসে থাকে ফুরফুরে ভাব। খাসিয়া পাহাড়ের সবুজাভ চূড়ায় তুলার মত মেঘরাজির বিচরণ এবং যখন তখন আকাশের কান্না পাহাড়ি পথ হয়ে উঠে বিপদ সংকুল। সেই সঙ্গে কয়েক হাজারফুট উপর থেকে নেমে আসা সফেদ ঝর্ণাধারার দৃশ্য যে কারোরই নয়ন জুড়িয়ে যায়।

আবার শীতে অন্য রূপে হাজির হয় জাফলং। চারিদিকে তখন সবুজের সমারোহ, পাহাড় চূড়ায় গহীন অরণ্য। ফলে শীত এবং বর্ষা সব সময়েই বেড়ানোর জন্য উপযুক্ত স্থান হতে পারে জাফলং। জাফলংয়ের বুক চিড়ে বয়ে গেছে দুই নদী। ধলাই ও পিয়াইন। এই নদী দুইটি অনন্যতা এনে দিয়েছে জাফলংকে।

বাংলাদেশে চার ধরণের কঠিন শিলা পাওয়া যায়, তন্মধ্যে ভোলাগঞ্জ-জাফলং-এ পাওয়া যায় কঠিন শিলার নুড়ি। এছাড়া বর্ষাকালে ভারতীয় সীমান্তবর্তী শিলং মালভূমির পাহাড়গুলোতে প্রবল বৃষ্টিপাত হলে ঐসব পাহাড় থেকে ডাউকি নদীর প্রবল স্রোত বয়ে আনে বড় বড় গণ্ডশিলাও। এ কারণে সিলেট এলাকার জাফলং-এর নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাথর পাওয়া যায়। আর এই এলাকার মানুষের এক বৃহৎ অংশের জীবিকা গড়ে উঠেছে এই পাথর উত্তোলন ও তা প্রক্রিয়াজাতকরণকে ঘিরে। জাফলং-এ পাথর ছাড়াও পাওয়া গেছে সাদামাটি বা চীনামাটিও।

এই এলাকায় যেমন সাধারণ বাঙালিরা বসবাস করেন, তেমনি বাস করেন উপজাতিরাও। জাফলং-এর বল্লা, সংগ্রামপুঞ্জি, নকশিয়াপুঞ্জি, লামাপুঞ্জি ও প্রতাপপুর জুড়ে রয়েছে ৫টি খাসিয়াপুঞ্জী। আদমশুমারি অনুযায়ী জাফলং-এ ১৯৫৩ জন খাসিয়া উপজাতি বাস করেন।

ঐতিহাসিকদের মতে হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা-রাজার অধীনে থাকা এক নির্জন বনভূমি। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে খাসিয়া-জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটলেও বেশ কয়েক বছর জাফলংয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা পতিতও পড়েছিল। পরবর্তীতে ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌপথে জাফলং আসতে শুরু করেন, আর পাথর ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকলে একসময় গড়ে ওঠে নতুন জনবসতি।

যাওয়ার উপায়:

বাস: ঢাকা থেকে সিলেট এর উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায় গাবতলি এবং সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে। বাস গুলো সকাল থেকে রাত ১২.৪৫ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময় পরপর ছেড়ে যায়। ঢাকার ফকিরাপুল, সায়দাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সিলেটের বাসগুলো ছাড়ে। এ পথে গ্রিন লাইন পরিবহন, সৌদিয়া পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন ও এনা পরিবহনের বাস চলাচল করে। ভাড়া ৮শ’ থেকে ১ হাজার ১শ’ টাকা। এছাড়া শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ইউনিক সার্ভিস, এনা পরিবহনের পরিবহনের নন এসি বাস সিলেটে যায়। ভাড়া ৪শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা। এনা পরিবহনের বাসগুলো মহাখালী থেকে ছেড়ে টঙ্গী ঘোড়াশাল হয়ে সিলেট যায়।

ট্রেন: ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টায় ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৪ টায় ছাড়ে কালনী এক্সপ্রেস। ভাড়া দেড়শ থেকে ১ হাজার ১৮ টাকা।

আকাশপথ: ঢাকা থেকে বিমানযোগেও সিলেট যেতে পারেন। এজন্য শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ, ইউএস বাংলা এয়ার, নভো এয়ার, ইউনাইটেড এয়ার, রিজেন্ট এয়ারের বিমানে করে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়া যাবে।

সিলেট থেকে জাফলং:

সিলেট থেকে প্রায় সকল প্রকার যানবাহনেই জাফলং যাওয়া যায়। লোকাল বাসে যেতে শহরের শিবগঞ্জ থেকে বাসে উঠতে হবে ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৮০ টাকা। সিএনজি বা অটোরিকশায় ভাড়া পড়বে ১২০০-২০০০ টাকা। মাইক্রোবাস যাওয়া আসার জন্য রিজার্ভ নিলে সারা দিনের জন্য ভাড়া পড়বে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। দলগত ভাবে গেলে মাইক্রোবাস ভাড়া করে গেলেই ভালো হয়। তাহলে আশপাশের অন্যান্য জায়গাও ঘুরে আসা যাবে।

কোথায় থাকবেন: 

গেস্ট হাউজ ও রেস্ট হাউজের তথ্য:


জেলা পরিষদের রেস্ট হাউজ, উপজেলা হেড কোয়ার্টার ( ০১৭৩০ ৩৩১০৩৬, ০১৭৩৭৬৯৬৭৮১)।

নলজুরী রেস্ট হাউজ- নলজুরী, জাফলং (০১৭১১-৯৬৬০১৯, ০১৭৫২-২২৬৩৭৫)।

গ্রীণ পার্ক রেস্ট হাউজ, নলজুরী, জাফলং (০১৭১১-১৮০৫৭৪, ০১৭৬৬-৮৫৭১৬৮)।

সওজ বাংলো, জাফলং- (০১৭৩০ ৭৮২৬৬২)।

এছাড়া সিলেট শহরে ফিরে আসলে সেখানে পাবেন ভালো মানের কিছু আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট। তাদের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে।

শহরের শাহজালাল উপশহরে হোটেল রোজ ভিউ (০৮২১-৭২১৪৩৯)।

দরগা গেইটে হোটেল স্টার প্যাসিফিক (০৮২১-৭২৭৯৪৫)।

ভিআইপি রোডে হোটেল হিলটাউন (০৮২১-৭১৬০৭৭)।

বন্দরবাজারে হোটেল মেট্রো ইন্টারন্যাশনাল (০৮২১-৭২১১৪৩)।

নাইওরপুলে হোটেল ফরচুন গার্ডেন (০৮২১-৭১৫৫৯০)।

জেল সড়কে হোটেল ডালাস (০৮২১-৭২০৯৪৫)।

লিঙ্ক রোডে হোটেল গার্ডেন ইন (০৮২১-৮১৪৫০৭)।

আম্বরখানায় হোটেল পলাশ (০৮২১-৭১৮৩০৯)।

দরগা এলাকায় হোটেল দরগাগেইট (০৮২১-৭১৭০৬৬)।

হোটেল উর্মি (০৮২১-৭১৪৫৬৩)।

জিন্দাবাজারে হোটেল মুন লাইট (০৮২১-৭১৪৮৫০)।

তালতলায় গুলশান সেন্টার (০৮২১-৭১০০১৮) ইত্যাদি।

এছাড়া আরও কয়েকটি হোটেল হল - হোটেল হিল টাউন, গুলশান, দরগা গেইট, সুরমা,কায়কোবাদ ইত্যাদি। লালা বাজার এলাকায় কম ভাড়ায় অনেক মানসম্মত রেস্ট হাউস আছে। হোটেল অনুরাগ - এ সিঙ্গেল রুম ৪০০ টাকা (দুই জন আরামসে থাকতে পারবেন), তিন বেডের রুম ৫০০টাকা (নরমালই ৪জন থাকতে পারবেন)। রাত যাপনের জন্য দরগা রোডে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। রুম ভাড়া ৫০০- টাকা থেকে ৫০০০- টাকা পর্যন্ত।

রেস্টুরেন্ট:

জাফলং এ পর্যটকদের খাওয়ার জন্য বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট রয়েছে।

পর্যটন রেস্তোরা, জাফলং, তামাবিল জিরো পয়েন্ট (০১৮১৯৯-০৪০৭৫২)।

পিকনিক সেন্টার রেস্টুরেন্ট, জাফলং বল্লাঘাট (০১৭১২ ৭৪৬৪২৫)।

ক্ষুধা রেস্টুরেন্ট, জাফলং বল্লাঘাট (০১৭২১-৯১২৫১৭)।

এছাড়া খাওয়ার জন্য সিলেট শহরেও বিভিন্ন মানের রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সামর্থ্য অনুযায়ী একটিতে খেয়ে নিতে পারেন।

আরও পড়ুন...

সৌন্দর্যের লীলাভূমি লোভাছড়া

 

টাইমস/এএইচ/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
পৃথিবীর চেয়ে দ্বিগুণ বড় পানিসমৃদ্ধ ‘সুপার-আর্থ’ গ্রহের সন্ধান! Jul 06, 2025
img
মোদি সরকারকে ক-সা-ই আখ্যা দিলেন হাসনাত Jul 06, 2025
img
শেষ মুহূর্তের নাটকীয়তায় ডর্টমুন্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনালে রিয়াল Jul 06, 2025
img
গোড়ালি ভেঙে ছিটকে গেলেন বায়ার্ন তারকা জামাল মুসিয়ালা Jul 06, 2025
img
৯ জুলাইয়ের সময়সীমা পেরিয়ে নতুন বাণিজ্য চুক্তির পথে যুক্তরাষ্ট্র Jul 06, 2025
img
দ্বিতীয় ইনিংসেও গিলের সেঞ্চুরি, ম্যাচ বাঁচাতে লড়ছে ইংল্যান্ড Jul 06, 2025
img
পাকিস্তান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে মাইক্রোসফট Jul 06, 2025
img
মব তৈরি করে জামায়াত নেতাকে পুলিশে দেওয়ার অভিযোগ Jul 06, 2025
img
নয়জনের দল নিয়েও বায়ার্নকে হারিয়ে সেমিফাইনালে পিএসজি Jul 06, 2025
img
মুন্সীগঞ্জে দলিল লেখকপট্টিতে ভয়াবহ আগুন Jul 06, 2025
img
সদিচ্ছা না থাকলে উপদেষ্টার চেয়ার ছেড়ে দিন: রিফাত রশীদ Jul 06, 2025
img
সংসদ নির্বাচন আটকানোর শক্তি কারো নেই : গয়েশ্বর Jul 06, 2025
img
পিআর নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার নামে ছড়িয়ে পড়া ফটোকার্ড ভুয়া Jul 06, 2025
img
‘আমেরিকা পার্টি’ নিয়ে ইলন মাস্কের জনমত জরিপে ৬৫% সমর্থন Jul 06, 2025
img
হাতিরঝিলে রাতের আঁধারে হবে নারী দলের অভিনব সংবর্ধনা Jul 06, 2025
img
‘ম্যাডাম সেনগুপ্ত’ নামটাই যেন ঋতুপর্ণার পুরো চরিত্র Jul 06, 2025
img
অস্ত্রোপচারের পর বিশ্রামে দীপিকা কক্কর, মানতে হচ্ছে কড়া নিয়ম Jul 06, 2025
img
আজ পবিত্র আশুরা Jul 06, 2025
img
বিচার, সংস্কার এবং নতুন সংবিধানই হচ্ছে আমাদের প্রধান দাবি : নাহিদ ইসলাম Jul 06, 2025
img
প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক উৎসবমুখর নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় বিএনপি : প্রিন্স Jul 06, 2025