শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ মোহাম্মদ আলী

কিংবদন্তী বক্সার মুহাম্মদ আলী। তিনি একজন পথপ্রদর্শক। চরম আত্ম-প্রত্যয়ী, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দৃঢ় বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত তার ব্যক্তিত্ব। তাকে বলা হয় “শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ”।

উত্তর আমেরিকার বক্সিং ফেডারেশন চ্যাম্পিয়নশিপ ও অলিম্পিক স্বর্ণ পদকসহ তিনবার বিশ্ব হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন আলী।

১৯৪২ সালে আমেরিকার কেনটাকির লুইসভিলে আলীর জন্ম। বাবার দেয়া নাম কেসিয়াস মারসেলাস ক্লে। ১৯৭৫ সালে মুসলমান হওয়ার পর নাম বদলে রাখেন মোহাম্মদ আলী।

আলী ছয় ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা। তাই বক্সিংয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার কৌশল জানতেন তিনি। ১৯৬০ সালের ২৯ অক্টোবর লুইসভিলে আলী প্রথমবারের মতো পেশাগত লড়াইয়ে জয় পান। ১৯৬০-১৯৬৩ সময়ে তিনি ১৯টি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন, যেখানে ১৫টিতেই ছিলেন অপরাজিত।

এ সময় তিনি টনি এস্পার্টি, জিম রবিনসন, ডনি ফ্লেমন, অ্যালোঞ্জো জনসন, জর্জ লোগান, উইলি বেসম্যানফ, ল্যামার ক্লার্ক (যিনি আগের ৪০টি ম্যাচে অপরাজিত ছিলেন), ডগ জোন্স, সনি বেনস ও হেনরি কুপারের মতো বিখ্যাত বক্সারদের পরাজিত করেছেন।

তার কাছে পরাজিত হয়েছেন প্রবীণ বক্সার আর্চি মুর। এই বক্সিং কিংবদন্তী ২০০টিরও বেশি ম্যাচে লড়েছেন এবং এক সময় আলীর প্রশিক্ষক ছিলেন।

আলীর আত্মবিশ্বাস ও অসীম সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৬৪ সালে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় চ্যাম্পিয়ন বক্সার সনি লিস্টনের সাথে লড়াই করেছিলেন।

আলী রিংয়ের চারপাশে নাচতে নাচতে লিস্টনকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “আমি তোমায় প্রজাপতির মতো উড়িয়ে দেবো, মৌমাছির মতো কামড় দেবো। তোমার চোখ দেখতে পাবে না, তোমার হাত কখনো আঘাত করতে পারবে না”।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ১৯৬৪ সালে আলী সেনাবাহিনীর যোগ্যতা পরীক্ষায় ব্যর্থ হন। কারণ তার লেখা ও বানান দক্ষতা অপর্যাপ্ত ছিল। অবশ্য পরে ১৯৬৬ সালে তিনি সে যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হন।

কিন্তু তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, “পবিত্র কোরআনের শিক্ষা যুদ্ধের বিরুদ্ধে। আল্লাহ বা তার রাসুল কর্তৃক ঘোষণা না করা পর্যন্ত আমরা কোনো যুদ্ধে অংশ নিতে পারি না। আমরা খ্রিস্টান বা অবিশ্বাসীদের আহবানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারি না”।

আলী বলেছিলেন, “কেসিয়াস ক্লে একটি দাসের নাম। আমি চাই না মানুষ আমাকে এ নামে ডাকবে। আমার নাম মোহাম্মদ আলী। আমি চাই সবাই আমাকে এ নামেই ডাকবে”।

এরপর থেকে আলীর নাম নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। ১৯৬৬ সালে আলীকে কিছু দিনের জন্য আমেরিকায় বক্সিং থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর আলী বিদেশে পাড়ি জমান এবং বিভিন্ন দেশে বক্সিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।

এ সময় তিনি কানাডার বক্সার জর্জচুভালো, ইংল্যান্ডের হেনরি কুপার ও ব্রায়ান লন্ডন এবং জার্মানির কার্ল মিলেন বার্গারকে পরাজিত করেছিলেন।

১৯৬৬ সালের নভেম্বরে আলী আমেরিকায় ফিরে আসেন। আবার বক্সিংয়ে লড়াই শুরু করেন। ১৯৬৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি হিউস্টন বক্সিংয়ের রিংয়ে ফিরে আসেন এবং বক্সার টেরেলের সাথে লড়াই করেন।

বক্সিংয়ের ইতিহাসে এটা ছিল অতি আগ্রাসী এক লড়াই। আলীকে উত্তেজিত করতে টেরেল তাকে ক্লে নামে সম্বোধন করতেন। ক্ষুব্ধ আলী নৃশংসভাবে টেরেলকে পরাজিত করেন। আলী চাইলে তাকে অনেক আগেই রিংয়ের বাইরে ছুঁড়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তাকে অপমানের শাস্তি দিতে তিনি ম্যাচ ১৫ রাউন্ড পর্যন্ত টেনে নিয়েছিলেন।

সে সময় আলীর ইসলাম ধর্মের প্রতি সংহতি ও যুদ্ধবিরোধী মনোভাব আমেরিকার বর্ণবাদবিরোধী নাগরিক অধিকার আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল।

প্রতিক্রিয়ায় ১৯৬৭ সালে তাকে তিন বছরের জন্য পেশাদার বক্সিং থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। সেনাবাহিনীতে যোগদান প্রত্যাখ্যান করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। নির্বাসনে থেকেও তিনি যুদ্ধ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন।

১৯৭০ সালে আলী আবার বক্সিংয়ে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বক্সার ফ্রিজারের সাথে লড়াই করেন। ‘দ্য ফাইট অফ দ্য সেঞ্চুরি’ খ্যাত এ লড়াইয়ে আলী হেরে যান। আর পেশাদার বক্সিংয়ে এটাই আলীর প্রথম পরাজয়।

১৯৭৮ সালে আলী বাংলাদেশে এসেছিলেন। সে সময় বাংলাদেশ সরকার আলীকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দিয়েছিল।

১৯৮০ সালের দিকে আলীর পার্কিনসন রোগ ধরা পড়ে। তিনি অবসরে চলে যান। বিশ্বব্যাপী মানবকল্যাণে কাজ শুরু করেন। ৬০ মিলিয়ন ডলার তহবিল দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন “মোহাম্মদ আলী সেন্টার”।

আলী সেন্টারের দেয়া তথ্য মতে, আলী প্রতি বছর গড়ে ২০০ দিন বিদেশ ভ্রমণ করেছেন এবং প্রায় ২২ মিলিয়ন ক্ষুধার্তকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন।

১৯৯১ সালে তিনি “স্পিরিট অফ আমেরিকা” পুরস্কার পান। ১৯৯৬ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের মশাল প্রজ্জ্বলন করে সম্মানিত হন। ১৯৯৯ সালে বিবিসি স্পোর্টস পার্সোনালিটি অফ দ্য সেঞ্চুরি পুরস্কার পান।

২০০১ সালে তার জীবনী নিয়ে মুভি তৈরি করা হয়। ২০০৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের থেকে “প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম” পুরস্কার ও জাতিসংঘ থেকে “অটোহান শান্তি পদক” লাভ করেন।

২০০৫ সালের দিকে তার অবস্থা আরও খারাপ হয়। অবশেষে ২০১৬ সালের ৩ জুন বিশ্ববাসীকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান আলী।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় জামায়াত নেতা নিহত Oct 27, 2025
img
গর্ভবতী আলবেনিয়ার এআইমন্ত্রী দিয়েলা! Oct 27, 2025
img
দেশে প্রথমবার সফল ‘ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন’ ব্যাটারি প্রতিস্থাপন সম্পন্ন Oct 27, 2025
img
দেশের তিন বিভাগে বজ্রসহ বৃষ্টির আভাস Oct 27, 2025
img
৩ এলবিডব্লিউ করে হ্যাটট্রিক আফিফের Oct 27, 2025
img
শামীম ওসমানের সহযোগী আজিজ গ্রেপ্তার Oct 27, 2025
img
‘ইয়ামাল এখনো শিখছেন কিভাবে এই চাপ সামলাতে হয়’ Oct 27, 2025
img
যানজটে সালমান, বাইকে পৌঁছালেন শুটিং ফ্লোরে Oct 27, 2025
img
৬ জুয়ারিকে শনাক্ত বিসিবির Oct 27, 2025
img
ঘূর্ণিঝড় ‘মন্থা’র প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে কি না বার্তা আবহাওয়া অফিসের Oct 27, 2025
img
রাজধানীতে আওয়ামী লীগের ৮ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার Oct 27, 2025
img
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ডিসেম্বরে Oct 27, 2025
img
কুয়ালালামপুরে রুবিও-জয়শঙ্কর বৈঠক, কী আলোচনা হলো? Oct 27, 2025
img

২৭ অক্টোবর

দেশের টাকায় আজকের মুদ্রা বিনিময় হার Oct 27, 2025
img
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন ট্রাম্প Oct 27, 2025
img
মেট্রোরেল চলাচল শুরু Oct 27, 2025
img
এনসিপির যশোরের প্রধান সমন্বয়কারী নুরুজ্জামান Oct 27, 2025
img
চাঁদপুরে খেলনা পিস্তলসহ ২৮ দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার Oct 27, 2025
img
নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে পদত্যাগ করুন : ব্যারিস্টার অসীম Oct 27, 2025
img
রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ সম্মেলন নির্ভর করছে ওয়াশিংটনের ওপর: ল্যাভরভ Oct 27, 2025